কীভাবে আমরা সহজে আরবী শিখব?

কীভাবে সহজে আরবী শিখব 1 Al-Ilm Academy

আরবী ভাষা বিশ্বব্যাপী অন্যতম বিস্তৃত একটি ভাষা, যার ভাষাভাষীর সংখ্যা প্রায় ৪২২ মিলিয়ন। এটি আরব বিশ্বের সকল দেশের সরকারিভাষা হিসেবে স্বীকৃত, পাশাপাশি আরও কিছু দেশে—যেমন চাদ ও ইরিত্রিয়া—এ দেশের মানুষ আরবী ভাষায় কথা বলে। এটি জাতিসংঘের স্বীকৃত ছয়টি সরকারি ভাষার একটি। জাতিসংঘ ১৮ ডিসেম্বর তারিখটিকে আন্তর্জাতিক আরবী ভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে, এবং প্রতি বছর এই দিনে তা উদযাপন করা হয়।

আরবী ভাষা শেখা বিশেষ করে একজন মুসলিমের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এর মাধ্যমেই ব্যক্তি কুরআনুল কারীমের অর্থ ও তাৎপর্য বুঝতে পারেন, এবং হাদীস ও রাসূলুল্লাহ ﷺ–এর শিক্ষাগুলোর সঠিক উপলব্ধি লাভ করতে পারেন। বক্ষমাণ আলোচনায় সহজে আরবী শেখার কিছু পদ্ধতি তুলে ধরা হলো-

আরবী ভাষা শেখা: পড়া ও লেখা
আরবী ভাষা পড়া ও এর শব্দগুলো লেখা শেখা একটি মৌলিক বিষয়, যা শেখা অত্যন্ত জরুরি, যদি আপনি এই ভাষায় দক্ষ হতে চান। এ ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম আছে, যেগুলো অনুসরণ করলে আপনি সহজে আরবী পড়া ও লেখা রপ্ত করতে পারবেন:

– আরবী ভাষার সবগুলো অক্ষর- হরফ মুখস্থ করা — পড়া ও লেখা উভয় ক্ষেত্রেই। এটাই হলো ভিত্তি, যার উপর আরবী ভাষার শব্দগুলো গঠিত হয়। প্রতিটি ভাষার একটি বর্ণমালা থাকে, এবং সেটাই সেই ভাষা শেখার প্রথম ধাপ ও মূল ভিত্তি।

– আরবী ভাষার হারাকাত, সুকূন, মাদ্দ হরফ ও অন্যান্য নিয়ম বোঝা। আরবী ভাষায় ব্যবহৃত হারাকাত (যেমন: ফাতহা, কাসরা, যাম্মা), সুকূন এবং মাদ্দ হরফসমূহ ভালোভাবে চিনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
মাদ্দের হরফ ও হারাকাতের পার্থক্য বুঝতে হবে। কারণ এইগুলো সঠিকভাবে জানলে শব্দগুলো সঠিকভাবে পড়া ও লেখা যায়। অনুরূপ প্রতিটি অক্ষর ফাতহা, কাসরা ও যাম্মাসহ পড়তে শেখা উচিত। যেমন: বা অক্ষর: (بَ – বা, بِ – বি, بُ – বু)
এছাড়াও, মাদ্দের হরফসহ পড়া শিখতে হবে। যেমন: با (বা), بى (বী), بو (বু)
প্রতিটি হরফকে এইভাবে পড়া ও লেখা উভয় দিক থেকেই শেখা দরকার।

– নূন সাকেন (نْ) ও তানউইন (ً ٍ ٌ) এর মধ্যে পার্থক্য করতে জানতে হবে। এই পার্থক্য জানা খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ শব্দের উচ্চারণ ও অর্থের ভিন্নতা এতে নির্ভর করে।

আরবী ভাষা শেখার আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক। যেমন:
– আল¬লাম আশ্‌শামসিয়্যাহ ও আল¬লাম আল¬কামারিয়্যাহ: উচ্চারণের ক্ষেত্রে شمسی لام (আল-লামে আশ্‌শামসিয়্যাহ) ও قمری لام (আল-লামে আল-কামারিয়্যাহ) এর মধ্যে পার্থক্য বুঝতে হবে এবং কোন কোন শব্দে কোনটি ব্যবহৃত হয়েছে তা চিহ্নিত করতে জানতে হবে।

– অক্ষরের অবস্থানভেদে লেখা শেখা:
প্রতিটি অক্ষর কিভাবে শব্দের শুরুতে, মাঝে এবং শেষে লেখা হয়, তা রপ্ত করতে হবে।

– হামযার উচ্চারণ ও লেখার নিয়ম জানা ও তার চর্চা করা উচিত। হামযা কখন ও কোথায় কিভাবে লেখা হয়, তা বুঝে নিয়ে নিয়মিত অনুশীলন করতে হবে।

– প্রথমে ১০০ শব্দ বিশিষ্ট সহজ পাঠ নির্বাচন করা, তা মুখস্থ করে লেখা এবং পরে ধীরে ধীরে আরও বড় পাঠ নিয়ে চর্চা করা।

▪পড়া ও লেখার সম্পর্ক খুবই গভীর। যত বেশি পড়া হবে, লেখার দক্ষতাও তত বাড়বে। আবার লেখার চর্চা করলে পড়ার ক্ষেত্রেও উন্নতি হবে।

বন্ধুদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফুস্বহা (সাহিত্যিক আরবী ভাষা) ব্যবহার করে লেখা ও যোগাযোগ করার অভ্যাস গড়ে তুললে ভাষার দক্ষতা অনেক দ্রুত বাড়ে।

শিশুদের জন্য আরবী ভাষা শিক্ষা:
শিশুদের আরবী ভাষা শিক্ষা কিছু ধাপে সম্পন্ন হওয়া উচিত। সেগুলো হলো-

– প্রথম ধাপ:
এই ধাপে প্রথমেই একটি ভালো শিক্ষক নির্বাচন করা জরুরি, যিনি শিশুদের সঠিকভাবে উচ্চারণ শেখাতে পারবেন। শিক্ষকের নিজের উচ্চারণ (مخارج الحروف) সঠিক হতে হবে এবং তাঁর মধ্যে এমন দক্ষতা থাকতে হবে, যাতে তিনি ধাপে ধাপে তথ্য সহজ ও দ্রুতভাবে শিশুদের মনে পৌঁছে দিতে পারেন।
এরপর শিক্ষককে মাদ্দ হরফ (আলিফ, ইয়াহ, ওয়াও) শেখানো শুরু করতে হবে। এই হরফগুলো পড়াতে গিয়ে সেগুলোকে টেনে পড়াতে হবে, যেন শিশুরা বুঝতে পারে যে এগুলো মাদ হরফ।

এরপর শিশুদের হিজায়ি (আরবী বর্ণমালা) শেখানো হবে, তবে অক্ষরের নাম দিয়ে নয়, বরং অক্ষরের ধ্বনি বা উচ্চারণ দিয়ে শেখানো হবে।

এরপর ধাপে ধাপে হারাকাত (ফাতহা, কাসরা, যাম্মা ইত্যাদি) শেখানো শুরু হবে। তবে প্রতি ক্লাসে চারটির বেশি অক্ষর শেখানো উচিত নয়, যেন শিশুদের মনে সহজে ধারণ হয়।

– দ্বিতীয় ধাপ:
এই ধাপে, শিশুকে মাদ্দের হরফের (আলিফ, ওয়াও, ইয়াহ) সঙ্গে অন্যান্য বর্ণ মিলিয়ে সংযুক্ত অক্ষরসমূহ শেখানো হয়, তবে প্রতিটি পাঠে সাতটির বেশি অক্ষর শেখানো উচিত নয়।
এরপর শিশু যেন মাদ্দের হরফগুলো স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। তারপর মাদ্দের হরফসম্বলিত কিছু শব্দ দেওয়া হবে, যেগুলো শিশু লিখবে ও পড়বে।

এছাড়া, শিশুর শেখা বিষয়গুলো যাতে মজবুতভাবে মনে থাকে, সে জন্য নিয়মিত পুনরাবৃত্তি (রিভিশন) করা জরুরি। এ জন্য শিশুদের কাগজে অনুশীলনমূলক কাজ (ওয়ার্কশিট) দিতে হবে। প্রত্যেক ধাপ থেকে দ্রুত ও সফলভাবে অগ্রসর হওয়ার জন্য প্রতিটি ধাপের শেষে এই অনুশীলনগুলো অবশ্যই সম্পন্ন করতে হবে।

– তৃতীয় ধাপ:
এই ধাপে শিশুরা হারাকাত (যেমন: ফাতহা, কাসরা, যাম্মা) এর আকৃতি ও উচ্চারণ শিখবে।
তারা বিভিন্ন অক্ষরের সংযোগ করে উচ্চারণ শিখবে। যেমন: بو (বু), أوسع (আওসা’) ইত্যাদি।
এছাড়াও তারা তিনটি অক্ষর নিয়ে গঠিত শব্দ পড়তে ও লিখতে শিখবে। যেমন: كَتَبَ (লিখেছে), زَرَعَ (বপন করেছে)।

এই ধাপে শিশু আলিফ লাম পরিচয়চিহ্ন (حرف التعريف “ال”) সম্পর্কেও পরিচিত হবে।
যেমন: الكتاب (আল-কিতাব – বই), الكراسة (আল-কুররাসাহ – খাতা)।
এই ধাপের শেষে, একজন শিশু-
• সব অক্ষর পড়তে সক্ষম হয়
• তিন অক্ষরের শব্দ পড়া ও লেখা পারে
• পরের শব্দে আরও অক্ষর যোগ করে বড় ও বৈচিত্র্যময় শব্দ শিখতে পারে
• এরপর সম্পূর্ণ বাক্য পড়া ও লেখা শেখে
• এবং অবশেষে শুরু হয় ইমলা বা শুনে লেখার (ডিকটেশন) ধাপ।
এভাবে ধাপে ধাপে শিশুর আরবী পড়া ও লেখার দক্ষতা পরিপূর্ণভাবে গড়ে ওঠে।

প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য আরবী ভাষা শিক্ষা:
প্রথমেই আরবী ভাষার সমস্ত ২৮টি বর্ণ শেখা এবং সঠিকভাবে উচ্চারণ করে পড়তে পারা জরুরি। বড়দের জন্য আরবী ভাষা শেখার প্রাথমিক ধাপগুলো হলো-
১. তিনটি মাদ্দের অক্ষর – ا (আলিফ), و (ওয়াও), ي (ইয়া) – পড়া ও লেখা শেখা।

২. তিনটি হারাকাত (স্বরচিহ্ন) – ফাতহা (ـَ), যাম্মা (ـُ), কাসরা (ـِ) – পার্থক্য বোঝা ও ব্যবহার শেখা।

৩. ২৮টি বর্ণের প্রতিটি অক্ষরকে মাদ্দ বর্ণের সাথে যুক্ত করে লেখা ও পড়া অনুশীলন।

৪. প্রতিটি অক্ষরকে তিনটি হারাকাতের সাথে আলাদাভাবে লেখা ও পড়ার অনুশীলন।

▪ব্যাকরণের মৌলিক বিষয়গুলো শেখা জরুরি। যেমন:
– ক্রিয়া (فعل) ও নাম (اسم) চেনা।
– অতীত (ماضٍ), বর্তমান (مضارع), আদেশমূলক (أمر) ক্রিয়ার পার্থক্য করা।
– কিছু সাধারণ বাক্যের ই’রাব (ব্যাকরণ বিশ্লেষণ) শেখা।

এরপরের ধাপগুলো-
– নিজে নিজে বাক্য লেখা ও সঠিকভাবে সাজানো শেখা।
– বাস্তব জীবনের বাক্য শুনে শেখা, সেগুলো অনুশীলন করা।
– নিজ থেকে বাক্য গঠন করার চেষ্টা – এটি আত্মবিশ্বাস ও ভাষায় দক্ষতা বাড়ায়।

▪আরবী শেখার জন্য সহায়ক কিছু উপায়:
– নিজে নিজে তথা স্বশিক্ষার উপযোগী বই সংগ্রহ করা – ধাপে ধাপে শেখার জন্য এসব বই খুবই কার্যকর।
– সহজ আরবী গল্প (বিশেষ করে শিশুদের গল্প) পড়া, যেহেতু সেগুলো সহজ ভাষায় লেখা হয়।
– টিভির সংবাদ বা স্ক্রলে লেখা তথ্য পড়া এবং রাস্তায় বিজ্ঞাপনের লেখা পড়ার অভ্যাস করা।
– ইউটিউব বা টিভিতে আরবি ভাষা শেখানোর প্রোগ্রাম দেখা।
– ইউটিউবে কুরআন থেকে ক্বারীর সাথে কুরআন তিলাওয়াত করে পড়া শেখা, বা কুরআনের চ্যানেল দেখা – এতে একসাথে দেখা, শোনা ও পড়া হয়, যা শেখাকে স্থায়ী করে।

▪পাঠক্রমে অগ্রগতি আনতে:
– সহজ ভাষায় লেখা কিছু সংক্ষিপ্ত অনুচ্ছেদ নির্বাচন করে পড়া।
– পরে ধাপে ধাপে কঠিন অনুচ্ছেদে অগ্রসর হওয়া, এভাবে ধীরে ধীরে দক্ষতা তৈরি হয়।
এইভাবে পরিকল্পিত ও ধাপে ধাপে শেখার মাধ্যমে প্রাপ্তবয়স্করাও সহজেই আরবী ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে পারেন।

▪ফুসহা (শুদ্ধ/সাহিত্যিক) আরবী ভাষা শিক্ষা:
একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি দুইটি পদ্ধতির মাধ্যমে ফুসহা (শুদ্ধ ও সাহিত্যিক) আরবি ভাষা শিখতে পারেন। যথা-
১. সংযোজনমূলক পদ্ধতি (الطريقة التركيبية)
২. বিশ্লেষণমূলক পদ্ধতি তথা-
الطريقة التحليلية (تحليل الأصوات والكلمات)

– সংযোজনমূলক পদ্ধতি (الطريقة التركيبية): এই পদ্ধতিতে শিক্ষা হয় ধাপে ধাপে –
শব্দ → বর্ণ → শব্দগুচ্ছ → বাক্য এভাবে সাজানো হয়।

১. ধ্বনি (الأصوات): শিক্ষার্থী প্রথমে ধ্বনিগুলো শুনে শুনে উচ্চারণ অনুশীলন করে, যেন তার মুখের উচ্চারণ সঠিক হয়। এটি হলো শুদ্ধ আরবী শেখার ভিত্তি।

২. বর্ণ (الحروف): প্রতিটি বর্ণের আলাদা রূপ শেখা। বর্ণটি শব্দের শুরু, মাঝ ও শেষে কেমন হয় তা শেখা। কিভাবে বর্ণ সংযুক্ত হয় এবং লেখার নিয়ম বুঝে নেওয়া

৩. শব্দ (الكلمات): ঠিক যেভাবে বর্ণ শিখেছিল, সে ধরণের পদ্ধতিতে শব্দ শেখা শুরু করে শুরুতে তিন অক্ষরের শব্দ দিয়ে শুরু করা। তারপর ধীরে ধীরে বড় ও জটিল শব্দে অগ্রসর হওয়া

৪. বাক্য (الجمل): বাক্য পড়া ও লেখা শেখা। সঠিকভাবে বাক্য গঠন করার অনুশীলন করা। এ পর্যায়ে ব্যাকরণ (النحو) ও সরফ (الصرف) এর প্রাথমিক নিয়মাবলি শেখা জরুরি।
এই সংযোজনমূলক পদ্ধতিতে শেখার ফলে শিক্ষার্থী আরবী ভাষার চারটি স্তম্ভে দক্ষ হয়ে উঠতে পারে — শোনা, বলা, পড়া ও লেখা।
এটি বিশেষ করে সাহিত্যিক বা ফুসহা আরবী শেখার জন্য খুব কার্যকর একটি পদ্ধতি।

– বিশ্লেষণমূলক পদ্ধতি (الطريقة التحليلية): এই পদ্ধতিটি শুরু হয় প্রথম পদ্ধতির শেষ থেকে, অর্থাৎ শিক্ষার্থী এখানে বাক্যের উচ্চারণ এবং গঠন শিখে। এর মাধ্যমে সে ধীরে ধীরে শব্দ এবং বর্ণগুলো চিনতে ও বুঝতে পারে।

▪আরবী ব্যাকরণ শিক্ষা:
আরবী ভাষা শেখা থেকে ব্যাকরণ শেখাকে আলাদা করা যায় না। কারণ ব্যাকরণ শেখা হলো আরবী ভাষা শিখার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোর একটি। নাহু (ব্যাকরণ) ও সরফ (উপপদ রূপবিদ্যা) এর নিয়মাবলি শেখা আপনাকে ভাষায় পারদর্শী করে তুলবে, এবং আপনার ভাষাকে ভুল থেকে মুক্ত রাখবে। অতএব, আরবী ভাষায় দক্ষ হতে হলে ব্যাকরণের নিয়ম ভালোভাবে শেখা আবশ্যক।

– আরবী শেখা একটি ধাপে ধাপে চলা প্রক্রিয়া। ধৈর্য, নিয়মিত চর্চা, এবং সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে যে কেউ সহজেই এই ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে পারে—বিশেষ করে মুসলিমদের জন্য, এটি কুরআনের ভাষা শেখার একটি পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। মহান আল্লাহ সকলকে শেখার তৌফিক্ব দান করুন। আমীন!

#Learn_Arabic_With_Al-Ilm_Team

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *