মুহাম্মাদ বিন হুসাইন আল-জীযানী
উসতায, উসুলুল ফিকহ, জামিয়া ইসলামীয়া মাদীনা
সংক্ষিপ্ত অনুবাদ: সাব্বির রায়হান বিন আহসান হাবিব
[অধ্যয়নরত, কিং আব্দুল আযীয বিশ্ববিদ্যালয় কো-অর্ডিনেটর, আল-ইলম একাডেমী]
প্রধান তিনটি মূলনীতিকে সামনে রেখে মোট ২৩টি কায়েদার সাহায্যে বিদআতকে চিহ্নিত করা সম্ভব। প্রথম মূলনীতিতে মোট ১০টি কায়েদার সন্নিবেশ ঘটেছে, যা নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
প্রথম মূলনীতি: শরীয়তে বর্ণিত হয়নি এমন প্রক্রিয়ায় আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা।
মূলনীতির ব্যখ্যা: আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের ক্ষেত্রে আমাদেরকে দুটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে: ১. ইবাদাতের মূল এবং ২. তার পদ্ধতি প্রমাণিত হওয়া।
ইবাদাতের মূল প্রমাণিত হওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে বিশুদ্ধ শারয়ী দলীলের উপর নির্ভরশীল। তবে নিম্নোক্ত উপায়ে এর ব্যতিক্রম হয়ে থাকে। যেমন:
• কোনো মিথ্যা হাদীস কিংবা দলীলের অনুপযুক্ত কোনো ক্বওল বা বক্তব্য ইবাদাতের ভিত্তি হওয়া
• অথবা ইবাদাতটি নাবী ﷺ এর আস-সুন্নাতুত তারকিয়্যাহ [ব্যাখ্যা আসছে] বা সালাফদের আমল কিংবা শারয়ী মূলনীতির বিপরীত হওয়া
আর ইবাদাতের পদ্ধতির ক্ষেত্রে সেটা অবশ্যই মূলগত দিকে থেকে এবং পদ্ধতিগত দিক থেকে শরীয়ত সমর্থিত হতে হবে। তবে এই পদ্ধতির ক্ষেত্রেও ব্যত্যয় ঘটে থাকে, যেমন:
• ইবাদাত মূলগত দিক থেকে শারীয়তসম্মত না হওয়া
• অথবা কোনো পাপ কাজ করা [এ দুটি মূল]
• অথবা মূলগত দিক থেকে শরীয়ত সম্মত হলেও পদ্ধতিতে কোনো পরিবর্তন আসা; সেটা হতে পারে মুকাইয়্যাদ ইবাদাতকে মুতলাক করা কিংবা মুতলাক ইবাদাতকে মুকাইয়্যাদ করার মাধ্যমে।
কায়েদা ০১. রাসূল ﷺ এর নামে বর্ণিত মিথ্যা হাদীস ভিত্তিক সকল ইবাদাত বিদআত। (আল-ই‘তিসাম, ইমাম শাতিবী (রহঃ) ১/২২৪-২৩১)
উদাহরণ:
• বিভিন্ন সূরার ফযীলত সংক্রান্ত বানোয়াট হাদীস।
• সলাতুর রাগায়েব বা রজব মাসের প্রথম শুক্রবার রাত্রে মাগরিব ও এশার মাঝামাঝি সময়ে যে সলাত আদায় করা হয়।
কায়েদার ব্যাখ্যা: এই কায়েদাটি শরীয়তের একটি বড়ো মূলনীতি থেকে উৎসারিত, আর তা হলো:
‘ইবাদাতের মূল হলো তাওকীফ বা স্থগিত’
অর্থাৎ, শারয়ী আহকাম কোনভাবেই কুরআন ও সুন্নাহর গ্রহণযোগ্য বিশুদ্ধ দলীল ছাড়া অন্য কোনভাবে প্রমাণিত হবে না। সুতরাং, রাসূল ﷺ এর নামে বানোয়াট হাদীসগুলো আদতে সুন্নাহ হিসেবে ধর্তব্য নয়। এগুলো শরীয়ত সমর্থিত না হওয়ার কারনে এগুলোকে ভিত্তি করে আমল করা বিদআত।
কায়েদা ০২. কোনো একক রায় ও প্রবৃত্তির উপর ভিত্তি করে যে ইবাদাত করা হয় তা বিদআত। (আল-ই‘তিসাম, শাতিবী, ১/২১২-২১৯)
উদাহরণ:
• সূফীবাদের অসংখ্য আহকামের ভিত্তি হলো কাশফ, দর্শন ও বিভিন্ন অতিপ্রাকৃতিক বিষয়াবলি। এগুলোর উপর ভিত্তি করেই তারা হালাল-হারামের বিধান দিয়ে আসছে। (আল-ই‘তিসাম, শাতিবী, ১/২১২)
• ‘আল্লাহ আল্লাহ’ বলে [আল্লাহ শব্দের সাথে কোনপ্রকার বিশেষণ যুক্ত না করে] অথবা সর্বনাম ‘হু হু’ ব্যবহার করে বিদায়াতী যিকর করা এই দাবিরে যে, পরবর্তী প্রজন্মের কেউ কেউ না কী এমনটি করার আদেশ করে গিয়েছেন। (মাজমূউল ফাতাওয়া: ১০/৩৯৬)
• ফেরেশতা, নবী-রাসূল এবং মৃত বুজুর্গ ব্যক্তিবর্গের কাছে দুআ করা, সাহায্য চাওয়া। (ঐ: ১/১৫৯)
কায়েদার ব্যাখ্যা: এই কায়েদাটিতে বিদাআতীদের একটি উল্লেখযোগ্য আলামতের কথা বলা হয়েছে, আর সেটা হলো, ‘সকল বিদআতী তার বিদআতের স্বপক্ষে শারয়ী দলীল উপস্থাপন করে; চাই সেটা সহীহ হোক কিংবা যঈফ’। কোনো বিদআতী নিজেকে শরীয়তের গণ্ডির বাহিরে গণ্য করতে নারাজ।
মোটকথা, কুরআন ও সুন্নাহ বহির্ভূত ইবাদাত মাত্রই বিদআত। এমনকি যদি কোনো বিদআতী কুরআন-সুন্নাহ থেকে কোনো দলীলকে উপযুক্ত মনে করে দলীল দিয়েও থাকে, তবে সেটা আদতে বিজ্ঞজনদের কাছে মাকড়সার ঘরের মতোই ভঙ্গুর।
আত-ত্বরত্বুশী (রহঃ) বলেন: কোনো কাজ সমাজে ছড়িয়ে পড়লেই সেটাকে জায়েয বলা যাবে না। তেমনিভাবে কোনো কাজ অজানা বা গোপন থাকলেও সেটাকে নিষিদ্ধ বলা যাবে না। (আল-হাওয়াদিস ওয়াল বিদা‘, আত-ত্বরত্বুশী: ৭১)
তাকলীদ বিষয়ে কিছু কথা: কিছু তাকলীদ আছে যেটাকে গর্হিত তাকলীদ বলে আখ্যা দেওয়া হয়। যেমন বাপ-দাদার তাকলীদ করা, অযোগ্য ব্যক্তির তাকলীদ করা, সত্য প্রকাশিত হওয়ার পরও তাকলীদ করা, সময়-সুযোগ থাকার পরও অপ্রয়োজনে ইজতিহাদে সক্ষম এমন ব্যক্তির তাকলীদ করা, এমন ব্যক্তির তাকলীদ করা যার কথা কুরান-সুন্নাহর সাথে সাংঘর্ষিক।
কিন্তু যদি সাধারণ জনগণের মাঝে কেউ কোনো মুজতাহিদের তাকলীদ করে তবে সেটা গর্হিত তাকলীদের আওতাভুক্ত হব না। বরং সেটা একটি ব্যাপক আয়াতের হুকুমের অন্তর্ভুক্ত হবে যেখানে, আল্লাহ ﷻ বলেছেন: ‘তোমরা জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞাসা করো, যদি না জেনে থাকো’। [আন-নাহল: ৪৩] আর এধরনের তাকলীদ জায়েয হওয়ার ক্ষেত্রে মুকাল্লিদকে এটা মাথায় রাখতে হবে যে, মুজতাহিদ ব্যক্তিটি আল্লাহর দ্বীন ও শরীয়তের একজন প্রচারক মাত্র আর নিঃশর্ত আনুগত্য একমাত্র আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্যই নির্দিষ্ট।
সুতরাং, একজন সাধারণ লোক যখন সত্যটা জানতে পারবে এবং ভিন্ন মতটাই তার কাছে অধিক প্রণিধানযোগ্য হিসেবে সুস্পষ্ট হবে তখন তার জন্য তাকলীদ করা নিষেধ। (মাজমূউল ফাতাওয়া, ইবনে তাইমিয়্যাহ: ২২/২৪৯)
কায়েদা ০৩. কোনো ইবাদাতের কারণ, আবশ্যকতা বর্তমান থাকা এবং প্রতিবন্ধকতা না থাকা সত্ত্বেও যদি রাসূল ﷺ সেই ইবাদাতটি বর্জন করেন তবে সেই ইবাদাত করা বিদআত। (মাজমূউল ফাতাওয়া, ইবনে তাইমিয়্যাহ: ২৬/১৭২)
উদাহরণ:
• সলাতের শুরুতে মুখে নিয়ত করা
• পাঁচ ওয়াক্ত সলাত ব্যতীত আযান দেওয়া
• সাফা-মারওয়া সায়ী করার পর সলাত আদায় করা
কায়েদার ব্যাখ্যা: আস-সুন্নাহ আত-তারকিয়্যাহর সাথে এই কায়েদার সম্পৃক্ততা রয়েছে। নাবী ﷺ কর্তৃক কোনো কাজ না করাকে আস-সুন্নাহ আত-তারকিয়্যাহ বলা হয়। এটা দু’ভাবে জানা যায় (ইলামুল মুওয়াক্কিঈন, ইবনুল কায়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ: ৪/২৬৪):
ক. কোনো সাহাবী (রাঃ) যদি এভাবে বলে থাকেন যে, নাবী ﷺ অমুক অমুক কাজটি করেননি; যেমন হাদীসে এসেছে, ‘নাবী ﷺ আযান ও ইকামাত ছাড়াই ঈদের সলাত আদায় করেছেন’।
খ. সাহাবীগণ কর্তৃক রাসূল ﷺ এর এমন কোনো কাজের কথা বর্ণিত না হওয়া, যে কাজটি যদি নাবী ﷺ করতেন তবে তাদের (সাহাবীদের) সকলের অথবা অধিকাংশের অথবা কোনো একজনের মাঝে সেটা বর্ণনা করার আগ্রহ দেখা যেত। কিন্তু আদৌ এমনকিছু বর্ণিত হয়নি। যেমন:
• সলাতের শুরুতে মৌখিক নিয়ত করা
• সকাল-বিকাল ফরয সলাতের পর মুসল্লিদের দিকে ঘুরে দুআ করা এবং আমীন বলা
মোটকথা, একজন মুমিনের জন্য কর্তব্য হলো, রাসূল ﷺ যা করেছেন এবং যা করেননি, উভয়টিই সমানভাবে অনুসরণ করা।
নাবী ﷺ কোনো কাজ না করার বিষয়টি তিনটি অবস্থা থেকে খালি নয়;
ক. হয়ত কাজটি করার কোনো প্রয়োজন পড়েনি; যেমন যাকাত দানে অস্বীকারকারীদের সাথে যুদ্ধে জড়ানোর বিষয়টি। নাবী ﷺ কাজটি করেননি। কিন্তু এই ‘না করা’-টি সুন্নাত নয়। [অর্থাৎ, তাদের সাথে বরং যুদ্ধ ঘোষণা করা সুন্নাহ]
খ. অথবা হয়ত কাজটি করার পরিস্থিতি তৈরি হলেও প্রতিবন্ধকতা থাকার কারণে তিনি ﷺ কাজটি করেননি। যেমন, নাবী ﷺ রমাদান মাসের কিছুদিন জামাআত করে কিয়াম করেছিলেন, কিন্তু উম্মতের উপর ওয়াজিব হয়ে যেতে পারে এই আশংকায় পরবর্তীতে এটা আর করেননি। এই ‘না করা’-টিও সুন্নাত নয়।
গ. অথবা হয়ত কাজটি করার পরিস্থিতি ছিল এবং কোনো প্রতিবন্ধকতাও ছিল না; এই ‘না করা’-টি সুন্নাহ। যেমন, নাবী ﷺ তারাবীহর সলাতের জন্য আযান দেননি।
কায়েদা ০৪. সালফে সালেহীন (সাহাবী, তাবেঈন, তাবে তাবেঈন) যে ইবাদাত নিজে করেননি অথবা নিজ গ্রন্থে স্থান দেননি অথবা সংকলন করেননি অথবা ইলমী বৈঠকে উপস্থাপন করেননি; এই ইবাদতটি তখনই বিদআত হবে যদি ইবাদতটি করার চাহিদা থাকে এবং প্রতিবন্ধকতা না থাকে। (আল-বায়েস আলা ইনকারিল বিদা ওয়াল হাওয়াদিস, আবূ শামাহ আল-মাকদিসী: ৪৭)
উদাহরণ:
• সলাতুর রাগায়েব; আল্লামা ইয বিন আব্দুস সালাম (রহঃ) বলেন, ‘সলাতুর রাগায়েব বিদআত হওয়ার অন্যতম একটি দলীল হলো, সাহাবী, তাবেঈন, তাবে তাবেঈন কিংবা শরীয়ত নিয়ে যারাই কোনকিছু সংকলন করেছেন কারো থেকেই এই সলাতের প্রামাণিকতা বর্ণিত হয়নি। তারা বিষয়টি নিজ গ্রন্থে উল্লেখ করেননি, এমনকি ইলমী বৈঠকেও উল্লেখ করেননি। অথচ তাদের মাঝে মানুষকে শেখানোর যে চরম উৎসাহ ছিল তা বর্ণনাতীত।
• কোনো দিবস উপলক্ষ্যে মাহফিল ও উৎসব অনুষ্ঠান করা বিদআত। কারণ, উৎসব শরীয়তের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সুতরাং, এক্ষেত্রে ইত্তিবা আবশ্যক, ইবতিদা নয়।
কায়েদার ব্যাখ্যা: উল্লিখিত কায়েদার উৎস:
হুযাইফা (রাঃ) বলেন, ‘সাহাবীগণ (রাঃ) যেই ইবাদাত করেননি, তোমরা তা করো না। কারণ, প্রথম প্রজন্ম পরবর্তী উম্মতের জন্য কোনো মাক্বাল (কথা বলার সুযোগ) রাখেননি। তোমরা সেই পূর্ববর্তীদের পথের অনুসরণ করো। (বুখারীতে অনুরূপ: ৭২৮২)
মালিক বিন আনাস (রহঃ) বলেন, ‘এই উম্মতের প্রথম প্রজন্ম যা দিয়ে সফল হয়েছে তা অবলম্বন করা ব্যতীত উম্মতের শেষ প্রজন্ম সফল হতে পারবে না।’ (ইক্বতিদাউ আস-সিরাতিল মুসতাকীম, ইবনে তাইমিয়্যাহ: ২/২৪৩)
এই কায়েদাটির ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী কায়েদার সকল নিয়ম-কানুন, শর্তাবলী প্রযোজ্য। কারণ দুটোর সূত্র মূলত একই।
এক্ষেত্রে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি (জানা উচিত): এই উম্মতের ক্ষেত্রে যদি কোনো ইবাদাত করার যৌক্তিকতা দেখা দেয় তবে সেই ইবাদাতটি নাবী ﷺ এর পক্ষে সম্পাদন করা আরো বেশি যৌক্তিক। কারণ, তিনি উম্মতের মাঝে সবচেয়ে বেশি তাকওয়ার অধিকারী।
সালফে সালেহীনদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহঃ) বলেন, ‘নাবী ﷺ একটি কাজ করেননি, কিন্তু যদি সেটা শরীয়তে থাকতো তবে তিনি হয়ত করতেন অথবা অনুমতি দিতেন এবং তার পরবর্তী খলীফা সাহাবীগণ করতেন; এধরণের কাজ করা বিদআত ও ভ্রষ্টতা। এক্ষেত্রে ক্বিয়াস করাও নিষিদ্ধ। (মাজমূউল ফাতাওয়া, ইবনে তাইমিয়্যাহ: ২৬/১৭২)
কায়েদা ০৫. শরীয়তের মূলনীতি ও মাকসাদ-বিরোধী প্রতিটি ইবাদাত বিদআত। (আল-ইতিসাম, শাত্বিবী: ১/৪৯৬)
উদাহরণ:
• কেউ কেউ মনে করে যে যিকর-আযকার, দুআ ইত্যাদির ভিত্তি হলো ইলমুল হুরুফ। (ইলমুল হলো আরবি সংখ্যাতত্ত্বের একটি প্রক্রিয়া, যেখানে আরবি অক্ষরের জন্য নির্ধারিত সংখ্যাসূচক মান দ্বারা কুরআনের শব্দাবলীর মান নির্ণয় করা হয়। এর মাধ্যমে সাধারণত শব্দের লুকানো বার্তা উদ্ধার করার চেষ্টা করা হয়। সূত্র: উইকিপিডিয়া।)
• দুই ঈদের সলাতের জন্য আযান দেওয়া। নফল সলাতের জন্য কোন আযানের বিধান নেই। আযান শুধুমাত্র ফরয সলাতের জন্য নির্দিষ্ট।
• সলাতুর রাগায়েব। এই সলাত কয়েকভাবে শরীয়তের মূলনীতির বিপরীত,
ক. নাবী ﷺ জুমুআর রাত্রিকে ক্বিয়ামের জন্য নির্দিষ্ট করতে নিষেধ করেছেন।
খ. সলাতুর রাগায়েবের পদ্ধতি অনুসরণ করতে গিয়ে ব্যক্তির সলাতে স্থিরতা ঠিক রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে। কারণ, একাধিক তাসবীহ, প্রতি রাকাতে সূরা কদর ও ইখলাসের সংখ্যা গুনতে গিয়ে অধিকাংশ সময়ই হাতের আঙ্গুলের সাহায্য নিতে হয়।
এর মাধ্যমে দ্বীন ইসলামের মাকসাদ বা উদ্দেশ্য জানা এবং মূলনীতি আয়ত্ত করার গুরুত্ব প্রতীয়মান হচ্ছে।
কায়েদা ০৬. শরীয়তে উল্লেখ নেই এমন সামাজিক রীতিনীতি কিংবা মুআমালাত, যেগুলোর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা হয়, সেগুলো বিদআত। (আল-ইতিসাম, শাত্বিবী)
উদাহরণ:
• ইবাদাতের উদ্দেশ্যে পশমের কাপড় পরিধান করা। ((মাজমূউল ফাতাওয়া, ইবনে তাইমিয়্যাহ: ১১/৫৫৫)
• আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের উদ্দেশ্যে সার্বক্ষনিক নিরব থাকা অথবা রুটি, গোশত খাওয়া কিংবা পানি পান করা থেকে বিরত থাকা অথবা সারাক্ষণ সূর্যের নিচে থাকা এবং ছায়া গ্রহণ না করা।
কায়েদার ব্যাখ্যা: এই কায়েদাটি ঐ সকল সামাজিক রীতিনীতি ও মুআমালাতের সাথে নির্দিষ্ট যেগুলোর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে চাওয়া হয়। এখানে দু’ভাবে বিদআত এসে থাকে; ১. মূলগত এবং ২. পদ্ধতিগত।
একারণে এই কায়েদার অধীনে আলোচিত সকল উদাহরণই বিদআহ হাকীকী বা নিরেট বিদআতের শ্রেণীভুক্ত, যেগুলোর জুমলাতান ওয়া তাফসীলান (সার্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে) কোন ভিত্তি কিংবা দলীল নেই।
তবে এই সামাজিক রীতিনীতি ও মুআমালাত-গুলোই আবার ইবাদাতে পরিণত হয়, যখন এগুলোর সাথে বিশুদ্ধ নিয়ত অথবা সৎ কাজ করার নিয়ত যুক্ত হয়। তখন এগুলোকে বিদআত বলা হবে না। যেমন একটি হাদীস,
“আর আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্যে তুমি যা কিছুই খরচ কর তার উপর তোমাকে প্রতিদান দেয়া হবে। এমনকি, সে লোকমাটির বদৌলতেও যা তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে তুলে দিবে।” [বুখারী: ১৪০৯]
ইবনে রজব হাম্বলী (রহঃ বলেন, ‘কেউ যদি এমন কাজ করে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে চায় যা আল্লাহ ﷻ এবং তাঁর রাসূল ﷺ নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম হিসেবে নির্ধারণ করেননি তবে তার আমল বাতিল এবং প্রত্যাখ্যাত। [জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম, ইবনে রজব হাম্বলী: ১/১৭৮]
কায়েদা ০৭. আল্লাহ ﷻ নিষেধ করেছেন এমন কাজের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য অর্জন করা বিদআত [জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম, ইবনে রজব হাম্বলী: ১/১৭৮]:
উদাহরণ:
• গান শোনা অথবা নাচানাচি করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা। (দেখুন, (মাজমূউল ফাতাওয়া, ইবনে তাইমিয়্যাহ: ৩/৪২৭)
• কাফেরদের সাদৃশ্য গ্রহণ করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা। এই উদাহরণটিতে বিদআতের তিনটি মূলনীতি পাওয়া যায়।
কায়েদার ব্যখ্যা: পূর্বের কায়েদাটির ন্যায় এটাও মূলগত ও পদ্ধতিগত দিক থেকে বিদআত। সুতরাং, এটাও বিদাআহ হাকীকী বা নিরেট বিদআত। কিন্তু বিগত কায়েদাটি সামাজিক রীতিনীতির ক্ষেত্রে, আর এটি নিষিদ্ধ কার্যাবলী ও পাপকাজের ক্ষেত্রে।
ইমাম শাতিবী (রহঃ) বলেন, ‘প্রত্যেক নিষিদ্ধ ইবাদাত আসলে ইবাদাত নয়। যদি ইবাদাত হতোই তবে আল্লাহ ﷻ নিষেধ করতেন না। এরপরও যদি কেউ এগুলো করে তবে সে নিষিদ্ধ কাজ করল। আর যদি কেউ এগুলোকে ইবাদাত মনে করেই করে বসে তবে সে বিদাআতী। (আল-ইতসাম: ১/৫১২)
কায়েদা ০৮. সুনির্ধারিত পদ্ধতি সম্বলিত ইবাদাতের পদ্ধতিতে পরিবর্তন নিয়ে আসা বিদআত:
এই কায়েদার অধীনে কিছু পদ্ধতি:
১. সময়ের পরিবর্তন; যেমন যুল-হিজ্জাহর প্রথম দিনে কুরবানি করা।
২. স্থানের পরিবর্তন; যেমন মসজিদ ব্যতীত ভিন্ন জায়গায় ইতিকাফ করা।
৩. জাতগত পরিবর্তন; যেমন ঘোড়া দিয়ে কুরবানি করা
৪. পরিমাণ পরিবর্তন; যেমন ষষ্ঠ ওয়াক্ত সলাত বৃদ্ধি করা
৫. পদ্ধতি পরিবর্তন; যেমন অজুর ধারাবাহিকতায় পরিবর্তন করা
কায়েদার ব্যাখ্যা: একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতিকে ভিত্তি করে এই কায়েদাটি দাঁড়িয়ে আছে; আর তা হলো-
‘ইবাদাতের ক্ষেত্রে শরীয়তের উদ্দেশ্য দুটি বিষয়ের অনুসরণ ব্যতীত বাস্তবায়িত হবে না:
ক. বিশুদ্ধ দলীলের মাধ্যমে ইবাদাতের ভিত্তি/মূল প্রমাণিত হওয়া
খ. মুকাইয়্যাদ (শর্তযুক্ত) অথবা মুতলাক (শর্তবিহীন/সাধারণ), যেকোনভাবে ইবাদাতের পদ্ধতি প্রমাণিত হওয়া।
কায়েদা ০৯. যে সকল ইবাদাত কোনো আম (ব্যাপক) দলীল দ্বারা প্রমাণিত, এমন ইবাদাতকে কোনো নির্দিষ্ট সময় অথবা স্থানের সাথে বিনা দলীলে শরীয়তের উদ্দেশ্য মনে করে শর্তযুক্ত করা বিদআত।
কায়েদার ব্যাখ্যা: এই কায়েদাটি ঐ সকল ইবাদাতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যেগুলো মৌলিকভাবে প্রমাণিত, কিন্তু পদ্ধতিতে নতুনত্ব নিয়ে আসা হয়েছে।
উদাহরণ: কোনো মর্যাদাপূর্ণ দিনকে নির্দিষ্ট ইবাদাত দিয়ে বিশেষিত করা; অর্থাৎ, অমুক দিনে এতো রাকাত সলাত পড়া বা সদাকাহ করা। অথবা নির্দিষ্ট কোনো রাত্রিকে নির্ধারিত রাকাত সলাত কিংবা কুরআন খতম করে বিশেষায়িত করা।
কায়েদা ১০. ইবাদাতের নির্ধারিত পরিমাণে বৃদ্ধি ঘটিয়ে বাড়াবাড়ি করা এবং ইবাদাত পালনে কড়াকড়ি করা (আহকামুল জানায়েয: ২৪২):
উদাহরণ:
• আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য রাত্রে না ঘুমিয়ে সারারাত ধরে কিয়াম করা।
• সারা বছর টানা রোযা রাখা।
• বিবাহ না করা
• হজ্বের সময় জামরাতে বড়ো বড়ো পাথর নিক্ষেপ করা এই যুক্তিতে যে, এগুলো তো কংকর থেকেও ছোটো।
কায়েদার ব্যাখ্যা: এই কায়েদাটির ভিত্তি হলো নিম্নে বর্ণিত হাদীস, আনাস ইবনু মালিক থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, তিন জনের একটি দল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইবাদত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিবিগণের গৃহে আগমন করল। যখন তাঁদেরকে এ সম্পর্কে অবহিত করা হল, তখন তারা এ ইবাদতের পরিমাণ যেন কম মনে করল এবং বলল, আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সমকক্ষ হতে পারি না। কারণ, তার আগে ও পরের সকল গুনাহ্ মাফ করে দেয়া হয়েছে। এমন সময় তাদের মধ্য থেকে একজন বলল, আমি সারা জীবন রাতে সালাত (নামায/নামাজ) আদায় করতে থাকব। অপর একজন বলল, আমি সারা বছর রোযা পালন করব এবং কখনও বিরতি দিব না। অপরজন বলল, আমি নারী বিবর্জিত থাকব-কখনও শাদী করব না।
এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের নিকট এলেন এবং বললেন, “তোমরা কি ঐ সকল ব্যাক্তি যারা এরূপ কথাবার্তা বলেছ? আল্লাহর কসম! আমি আল্লাহকে তোমাদের চেয়ে বেশী ভয় করি এবং তোমাদের চেয়ে তাঁর প্রতি আমি বেশি আনুগত্যশীল; অথচ আমি রোযা পালন করি, আবার রোযা থেকে বিরতও থাকি। সালাত (নামায/নামাজ) আদায় করি এবং ঘুমাই ও বিয়ে-শাদী করি। সুতরাং যারা আমার সুন্নাতের প্রতি বিরাগ ভাব পোষণ করবে, তারা আমার দলভুক্ত নয়। [বুখারী: ৫০৬৩]
উপরের হাদীস থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, দ্বীনের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি সাধারণত দুটি ক্ষেত্রে হয়ে থাকে:
ক. ইবাদাতের ক্ষেত্রে; যার ফলে ব্যক্তি এমন ইবাদাতকে ওয়াজিব ও মুসতাহাবের কাতারে ফেলে দেয় যা আসলে ওয়াজিব কিংবা মুসতাহাব নয়।
খ. তায়্যিবাতের (বৈধ হালাল বস্তুর/বিষয়ের) ক্ষেত্রে; যার ফলে ব্যক্তি এমন কাজকে হারাম ও মাকরূহের কাতারে ফেলে দেয় যা আসলে মাকরূহ কিংবা হারাম নয়।
দ্বিতীয় মূলনীতি: দ্বীনি রীতিনীতি থেকে বেরিয়ে আসা।
মূলনীতির বিশ্লেষণ: দ্বীনের উসূল বা মূলনীতিগুলোকে পরিপূর্ণভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে ‘আল-ইনক্বিয়াদ’ তথা আনুগত্য অর্জিত হয়। আর দ্বীনের মাঝে নতুন নতুন মূলনীতি ও বিশ্বাসের প্রচলন ঘটানোর মাধ্যমে দ্বীনের প্রতি ‘মুখালাফাত’ বা বিরোধিতা/বিদ্বেষ প্রদর্শন করা হয়।
কায়েদা ১১. কুরআন-সুন্নাহর নস অথবা সালাফগণের ইজমার সাথে সাংঘর্ষিক যেকোন আকিদা-বিশ্বাস, মতাদর্শ এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান বিদআত।
উদাহরণ: কতিপয় দল-উপদল এমনকিছু হাদীস উপস্থাপন করে যেগুলো তাদের উদ্দেশ্য ও মাযহাবের সাথে যায় না। তারা দাবি করে যে, এই হাদীসগুলো বিবেক-বিরোধী এবং দলীলের চাহিদানুপাতিক নয়; সুতরাং এগুলো পরিত্যাজ্য। কবরের আযাব, পুল-সিরাত, মিযান ও আখিরাতের দিন আল্লাহর দিদার লাভকে অস্বীকারকারীরা তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু নাম মাত্র।
কায়েদার ব্যাখ্যা: যেসকল নামধারী মুসলিমরা দ্বীন ইসলামের নামে বিভিন্ন আকিদা-বিশ্বাস, মতাদর্শ জ্ঞানমূলক বিষয়ের সংযোজন ঘটিয়েছে, এই কায়েদাটি মূলত সেসকল বিষয়কেন্দ্রিক। এই দৃষ্টিকোণ থেকে নাস্তিক কিংবা কাফিরদের বিশ্বাস, মতাদর্শ ও জ্ঞান-বিজ্ঞান এই কায়েদার অন্তর্ভুক্ত নয়; যদি সেটা ইসলাম-বিরোধী হয় তবুও।
ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) এই কায়েদাটির সমর্থনে বলেন, ‘কিতাব, সুন্নাহ ও রাসূল ﷺ এর সাহাবীদের থেকে বর্ণিত আসার-এর সাথে দ্বন্দ্ব রয়েছে এমন প্রত্যেকটি বিষয়ই বিদআত’। [ইলামুল মুওয়াক্কিঈন: ১/৮০]
কায়েদা ১২. কুরআন-সুন্নাহতে যা বর্ণিত হয়নি এবং সাহাবী ও তাবেঈদের থেকে প্রমাণিত নয় এমন প্রতিটি আকিদা-বিশ্বাস বিদআত।
এই কায়েদার অন্তর্ভুক্ত কিছু বিষয়:
ক. ইলমুল কালাম বা কালামশাস্ত্র: ইবনু আব্দিল বার (রহঃ) এ ব্যাপারে ইজমা উপস্থাপন করেছেন যে, ইলমুল কালাম একটি বিদআতী কার্যকলাপ। তার বক্তব্য নিম্নে তুলে ধরা হলো:
‘সকল দেশের আহলুল ফিকহ ও আহলুল আসার এব্যাপারে একমত যে আহলুল কালাম বা কালামশাস্ত্রবিদরা বিদআতী ও পথভ্রষ্ট। কারো কাছে তারা আলেমদের সমপর্যায়ী নয় বা তাদের স্তরের কেউ নয়। আলেম তো তারাই যারা আসারবিদ ও ফকীহ (অর্থাৎ, যারা শরীয়তের নস বা উদ্ধৃতি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন) । এক্ষেত্রে তারা জ্ঞানের গভিরতা, বৈশিষ্ট্য ও বুঝের দিক থেকে বিভিন্ন স্তরের হয়ে থাকে। [জামিউ বায়ানিল ইলম ওয়া ফাদ্বলুহু: ২/৯৪২]
ইমাম আহমাদ (রহঃ) বলেন, ‘কালামের প্রচলন ঘটানো ব্যক্তির শেষ পরিণাম বিদআত ছাড়া অন্যকিছু নয়। কারণ কালামশাস্ত্র কখনো কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। [আল-ইবানাতুল কুবরা: ২/৫৩৯]
খ. সূফী তরীকা: সূফীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এমন কার্যক্রমকে উত্তম মনে করে যা কিতাব ও সুন্নাহতে আসেনি এবং যে কাজ সালফে সালেহীন করেননি।
গ. ব্যাখ্যাসাপেক্ষ শব্দাবলীকে বিনা শর্তে সাধারণভাবে সাব্যস্ত করা অথবা নাকোচ করা, যেমন জিহাত (দিক), জিসম (শরীর) ইত্যাদি।
ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রহঃ) বলেন, ‘সালাফদের মাঝে কেউ আল্লাহর শানে জিসম শব্দের না-বোধক কিংবা হ্যাঁ-বোধক প্রয়োগ করেননি। এমনকি জাওহার, তাহাইউয কিংবা এজাতীয় পরিভাষাও ব্যবহার করেননি। এগুলো অস্পষ্ট কিছু শব্দসমষ্টি মাত্র, যা কোনো সত্যকে সত্য প্রমাণিত করতে কিংবা মিথ্যাকে মিথ্যা বানাতে পারে না। … বরং এগুলো সালাফ ও ইমামগণের কাছে নিন্দনীয় কিছু বিদআতী শব্দমালা। [মাজমূ আল-ফাতাওয়া: ৩/৮১]
অস্পষ্ট ও ব্যাখ্যাসাপেক্ষ শব্দাবলীর ক্ষেত্রে সালাফদের মানহাজ সম্পর্কে ইবনু আবিল ইয আল-হানাফী (রহঃ) বলেন, ‘শরয়ী নস বা উদ্ধৃতিগুলোতে যে শব্দগুলো এসেছে সেগুলো ইসবাত ও নাফী দ্বারা সুরক্ষিত; অর্থাৎ, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ যে শব্দ ও অর্থগুলোকে সাব্যস্ত করেছেন আমরাও সেগুলোকে সাব্যস্ত করি, আর যা নাকোচ করেছেন আমরাও তা নাকোচ করি।
আর যে শব্দগুলোর সাব্যস্ত কিংবা নাকোচ হওয়ার ব্যাপারে কোনকিছুই বর্ণিত হয়নি সেগুলোর উদ্দেশ্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করা ব্যতীত কিছুই বলা যাবে না। যদি এগুলো সহীহ অর্থ বহন করে তবে অবশ্যই গ্রহণীয়। তবে সেক্ষেত্রে ব্যাখ্যাসাপেক্ষ দুর্বোধ্য শব্দাবলী ব্যবহার না করে শরীয়তে বর্ণিত শব্দাবলী ব্যবহার করা উচিত। তবে প্রয়োজন দেখা দিলে সেটা ভিন্ন কথা। [শারহুল আকীদা তহাবিয়্যাহ: ২৩৯]
কায়েদার ব্যাখ্যা: কিতাব ও সুন্নাহতে যে বিশ্বাস বা আকীদার কথা বর্ণিত হয়নি তা নিয়েই এই কায়েদাটি। বিদআতকে অসার করে দিতে এই কায়েদাটির ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে। এমনকি (অধিকাংশ) সালাফ ইমামগণ বিদআতীদের জবাবে এই কায়েদাটির ব্যাপক প্রয়োগ করেছেন।
ইমাম আহমাদ (রহঃ) একদিন ইবনে আবূ দাউদকে বললেন, ‘তোমরা মানুষকে যে দিকে আহ্বান করো সেসম্পর্কে আমাকে অবহিত করো; তোমরা কি এমনকিছুর দাওয়াত দিয়ে থাকো যেদিকে রাসূল ﷺ ডাকেননি? তিনি (ইবনে আবূ দাউদ রহঃ) বললেন, ‘না’। তখন ইমাম আহমাদ (রহঃ) বললেন, ‘তোমাকে দুটো কথার যেকোন একটা বিশ্বাস করতেই হবে; হয়ত তারা জানতেন অথবা তারা জানতেন না। যদি তুমি বলো যে তারা জানতেন এবং জানা বিষয়ে চুপ থেকেছিলেন তবে আমাদেরকেও চুপ থাকতে হবে। আর যদি তুমি বলো যে তারা জানতেন না, কিন্তু তুমি জানো, তবে হে মন্দ লোকের ছেলে মন্দ লোক, শুনে রাখো! তুমি আল্লাহর রাসূল ﷺ, খুলাফা রাশেদীনকে মূর্খ বলছ। [মাজমূউল ফাতাওয়া: ৪/৫]
কায়েদা ১৩. দ্বীন নিয়ে ঝগড়া, বাক-বিতণ্ডা ও তর্কে লিপ্ত হওয়া বিদআত।
এই কায়েদার অন্তর্গত কিছু বিষয়:
ক. মুতাশাবিহ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা। ইবনু তাইমিয়্যাহ (রহঃ) বলেন, ‘কারণ এটা এমন বিষয়ের প্রশ্ন যা সম্পর্কে মানুষের কোনো জ্ঞান নেই এবং এর উত্তর দেওয়া তাদের পক্ষে আদৌ সম্ভব না। [মাজমূউল ফাতাওয়া: ৪/৪]
খ. কিতাব ও সুন্নাহতে নেই এমন বিষয়ে মুসলমানদেরকে পরীক্ষায় ফেলে দেওয়া।
গ. উম্মতকে বিভক্ত করে দেয় এমন গোঁড়ামি ও পক্ষপাতিত্বতে লিপ্ত হওয়া। আর এই পক্ষপাতের উপর ভিত্তি করে মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরি করা কিংবা সম্পর্ক্কেচ্ছদ ঘটানো।
ঘ. বিনা দলীলে কোন মুসলমানকে কাফির কিংবা বিদআতী সাব্যস্ত করা।
কায়েদার ব্যাখ্যা: আকীদা ও দ্বীনের মূলনীতি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করার সাথে এই কায়েদাটি নির্দিষ্ট। সুতরাং, ফিকহ এবং শরীয়তের শাখা মাসাআলা নিয়ে বিতর্ক করার বিষয়টি এই কায়েদার অন্তর্ভুক্ত না।
কায়েদা ১৪. মানুষকে সামাজিক কার্যাবলী ও মুআমালাতে এমনভাবে জড়িয়ে রাখা যেন এগুলো শরীয়তের অংশবিশেষ
উদাহরণ: ইমাম শাতেবী (রহ:) এক্ষেত্রে ট্যাক্স এর উদাহরণ নিয়ে এসেছেন। অর্থাৎ, ট্যাক্স বর্তমানে এমনভাবে চালু হয়ে আছে যেন এটা একটি মানবরচিত দ্বীন যা পালন করা সকলের জন্য একান্তই আবশ্যক; হয়তো সবসময় অথবা নির্দিষ্ট সময় নির্ধারিত পদ্ধতিতে এটা আদায় করা হয়ে থাকে। এমনকি ট্যাক্স দিতে অস্বীকারকারীদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থাও করা হয়েছে। [আল-ইতিসাম: ২/৮০,৮১]
কায়েদার ব্যাখ্যা: এই কায়েদাটি সামাজিক রীতিনীতি ও পারস্পরিক লেনদেন বা মুয়ামালাতের সাথে নির্দিষ্ট। কারণ এটা আসলে দ্বীনের সুশৃংখল নিয়মকানুন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার নামান্তর। তবে এই কায়েদার অধীনে সমাজে প্রচলিত এমন কোনো যৌক্তিক ও বোধগম্য বিষয় অন্তর্ভুক্ত হবে না যা স্বভাবতই মানুষের জন্য কল্যাণকর। এটাকে তখন মাসলাহাহ মুরসালাহ বলা হবে, যা বিদআত নয়।
কায়েদা ১৫. দ্বীনের সুপ্রতিষ্ঠিত অবস্থানের বাহিরে গিয়ে কিছু করা এবং শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত শাস্তির মাঝে ব্যত্যয় ঘটানো বিদআত।
উদাহরণ:
ক. এমন কিছু বাতিল কৌশল অবলম্বন করা যার মাধ্যমে হারামকে হালাল করা এবং ওয়াজিবকে প্রত্যাখ্যান করার পায়তারা করা হয়। যেমন হিল্লাহ বিবাহ।
ইমাম শাতেবী (রহ:) বলেন, ‘কিছু মানুষ এমনকিছু কৌশলকে জায়েয করে নিচ্ছে যা মূলত বিদআতের প্রবেশদ্বার। আলেমগণ এগুলোকে বিদআত হিসেবেই আখ্যায়িত করেছেন। [আল-ইতিসাম: ২/৮৫,৮৬]
কায়েদার ব্যাখ্যা: দ্বীনের অকাট্য বিধিবিধানের সাথে এই কায়েদাটি সম্পৃক্ত। যেমন, যিনা, মদপান ইত্যাদির সুনির্ধারিত শাস্তির বিধান, উত্তরাধিকার সম্পত্তির ভাগ, কাফফারা, ইদ্দত ইত্যাদি।
ইমাম ইবনুল কায়্যিম (রহ:) বলেন, ‘আহকাম দুই ধরনের হয়ে থাকে:
ক. যা মূল অবস্থা থেকে কখনো পরিবর্তন হয় না। স্থান ও কালভেদে তা সর্বাবস্থায় একই অবস্থায় থাকে। কোনো ইমামের ইজতিহাদে এতে পরিবর্তন আসে না।
আর দ্বিতীয় প্রকার: যা মানুষের কল্যাণের দিকে তাকিয়ে পরিবর্তন হতেও পারে। এক্ষেত্রে সময়, স্থান ও অবস্থাভেদে বিধানের তারতম্য হয়ে থাকে। যেমন শরীয়তের ধমক মূলক শাস্তি (তাজীর)। [ইক্তিদাউস সিরাতিল মুস্তাকিম: ১/৪২২]
কায়েদা ১৬. কাফেররা বিশেষিত এমন ইবাদত কিংবা আচার-আচরণে তাদের সাদৃশ্য গ্রহণ করা বিদআত।
উদাহরণ: মুসলিম হয়ে কাফিরদের বিভিন্ন উৎসব উদযাপন করা। ইমাম যাহবী (রহঃ) বলেন, ‘এমনকি যিম্মী কাফিরদের জন্মদিন, বৃহস্পতিবারের অনুষ্ঠান, বড়দিন উদযাপন করাও বিদআত এবং নিকৃষ্ট কাজ।’ [আত-তামাসসুক বিস-সুনান: ১৩০]
কায়েদার ব্যাখ্যা: এই কায়েদাটি মূলত কাফিরদের সাদৃশ্য গ্রহণ সংক্রান্ত। সাদৃশ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে দুটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত:
ক. কাফিরদের সাথে এমন বিষয়ে সাদৃশ্য রাখা যেটা বিশেষভাবে তারা অনুশীলন করে থাকে এবং তারা সেটা নিজে বানিয়ে নেয়নি অথবা তাদের দ্বীনে নতুনভাবে সংযোজন করেনি।
ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহঃ) বলেন, ‘আরেকটি মূলনীতি হলো এই যে, তাদের যেকোন ইবাদাত কিংবা স্বভাবজাত কার্যাবলির সাদৃশ্য গ্রহণ করা বিদআত। সেক্ষেত্রে তাদের সাথে বিশেষিত কাজগুলোই হলো মূল ধর্তব্য বিষয়। …’ [ইক্বতিদাউস সিরাতিল মুসতাকীম, ১/৪২৩]
খ. কাফিরদের সাথে এমন বিষয়ে সাদৃশ্য রাখা যেটা তারা নিজেদের দ্বীনে নতুনভাবে বানিয়ে নিয়েছে।
কাফিরদের সাদৃশ্য ধারণ করার কারণে দ্বীনের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যেতে হয়; এটাই এক্ষেত্রে বিদআতের মূল কারণ। সুতরাং এই দৃষ্টিকোণ থেকে কাফিরদের বিপরীত করাটাই হলো মুখ্য বিষয়। কারণ আল্লাহর দ্বীনকে অন্যান্য দ্বীনের উপর বিজয় দান করাই হলো রাসূল প্রেরণের মুখ্য উদ্দেশ্য। একারণে সালাফগণ বলতেন, ‘আমাদের আলেমদের মধ্যে থেকে যে ফাসাদ সৃষ্টি করবে তার মাঝে ইহুদীদের সাদৃশ্যতা রয়েছে। আর আমাদের বান্দাদের মধ্যে থেকে যে ফাসাদ সৃষ্টি করবে তার মাঝে নাসারাদের সাদৃশ্যতা রয়েছে। [ইক্বতিদাউস সিরাতিল মুসতাকীম, ১/৬৭]
তবে দুটি বিষয় কাফরদের সাদৃশ্যতার অন্তর্ভুক্ত না:
ক. এমন কাজ যা উভয় শরীয়তে বিধিবদ্ধ অথবা যা শুধুমাত্র আমাদের জন্য বিধিবদ্ধ এবং তারাও এর উপর আমল করে; যেমন আশুরার সিয়াম, সলাত, সিয়াম। এমতাবস্থায় পদ্ধতিগত দিক থেকে বৈপরীত্য দেখা যায়, কিন্তু মূলগত দিক থেকে সাদৃশ্য রয়েছে।
খ. যে সকল মানবিক ও সামাজিক কাজে তাদের বিশেষত্ব ফুটে ওঠে না।
কায়েদা ১৭. কাফিরদের সাথে এমন ইবাদাত কিংবা আচার-আচরণে সাদৃশ্য রাখা যেটা তারা নিজেদের দ্বীনে নতুনভাবে বানিয়ে নিয়েছে।
উদাহরণ: ক. কাফিরদের লাইফস্টাইলের অনুসরণ, যা আমাদের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে ভয়ংকর আকারে দেখা যাচ্ছে। লা হাওলা ওয়া লা কুওওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।
খ. তাদের এমন অনুষ্ঠানের সাথে সাদৃশ্য রাখা যা মূলত তাদের দ্বীনের অংশ নয়; যেমন মা দিবস অথবা বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস ইত্যাদি।
একটি নোট: এমনকি কোনো পার্থিব মৌসুমে কাফিরদের উৎসব বা অনুষ্ঠানের সাদৃশ্য গ্রহণ করাটাও দ্বীনের ক্ষেত্রে তাদের সাদৃশ্য গ্রহণ করার অন্তর্ভুক্ত। কারণ প্রতিটি উৎসব দুটি বিষয়ের সমন্বিত রূপ; ১. শরীয়ত এবং ২. সংস্কৃতি বা আচার। অর্থাৎ, একই সময়ে এতে দুটো বিষয় একত্রিত হয়ে থাকে (ইবাদাত ও সংস্কৃতি)।
ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহঃ) বলেন, ‘শরীয়ত সমর্থিত উৎসব হলো সেটাই যেখানে ইবাদাত রয়েছে; যেমন সলাত, যিকর, সদাকাহ, পশু যবেহ। এবং যেখানে আদাত (আচার-আচরণ/সংস্কৃতি) রয়েছে; যেমন মানুষকে খাবার, পোশাক বিলিয়ে দেওয়া। [ইক্বতিদাউস সিরাতিল মুসতাকীম, ১/৪২২]
কায়েদার ব্যাখ্যা: কাফেররা তাদের দ্বীনে যেই নতুন নতুন বিষয় উদ্ভাবন করেছে সেগুলোর সাদৃশ্য গ্রহণ করলে দুটো দিক থেকে বিদআত হবে:
ক. কাফিরদের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি নব আবিষ্কৃত বিষয়।
খ. সাদৃশ্য ধারণ।
ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহঃ) বলেন, ‘…কারণ এটা যদি মুসলিমরা উদ্ভাবন করতো তবে বিষয়টা খুব মারাত্মক আকার ধারণ করতো। তাহলে ইতিপূর্বে কোনো নবীর শরীয়তে যদি এটা বিধিবদ্ধ না থাকে এবং কাফিররা যদি দ্বীনের নামে নতুন কিছুর উদ্ভাবন ঘটায় তখন বিষয়টা কেমন দাঁড়াবে? [ইক্বতিদাউস সিরাতিল মুসতাকীম, ১/৪২৩]
কায়েদা ১৮. জাহেলী যুগের এমন কোনো আমল করা যা ইসলামী শরীয়তের অংশ নয় তা বিদআত।
ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহঃ) এর মতে, জাহেলী দ্বারা উদ্দেশ্য হলো- ইসলাম-পূর্বে আহলুল জাহেলিয়্যাহ বা তৎকালীন মানুষেরা যে কাজগুলো করতো এবং অধিকাংশ জাহেল আরবরা যে সংস্কৃতির উপর অভ্যস্ত ছিল। [ইক্বতিদাউস সিরাতিল মুসতাকীম, ১/৩৯৮]
উদাহরণ: ক. আমার উম্মাতের মধ্যে জাহিলিয়াত বিষয়ের চারটি জিনিস রয়েছে যা তারা ত্যাগ করছে না। বংশ মর্যাদা নিয়ে গর্ব, অন্যের বংশের প্রতি কটাক্ষ, গ্রহ-নক্ষত্রের মাধ্যমে বৃষ্টি প্রার্থনা এবং মৃতদের জন্য বিলাপ করা। [মুসলিম: ৯৩৪]
খ. সুনান আবূ দাউদের একটি হাদীসে এসেছে যে, ‘ইসলামে কোন আকর নেই।
রাবী আবদুর রাযযাক (রহঃ) বলেনঃ জাহিলিয়াতের যুগে লোকেরা (মৃত ব্যক্তির) কবরের পাশে গিয়ে গরু বা ছাগল যবাহ করতো এ ধরনের কাজকে আকর বলা হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরূপ করতে নিষেধ করেছেন।’ [সহীহ, ৩২০৮]
গ. পুত্র সন্তানের ভূমিষ্ঠ হওয়ার সংবাদে খুশি হয়ে মানুষকে দাওয়াত করে খাওয়ানো।
কায়েদার ব্যাখ্যা: এই কায়েদাটি পূর্বেল্লোখিত দুটো কায়েদার সাথে সম্পৃক্ত। কায়েদাটি সাব্যস্ত করণে একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য,
একদিন আবূ বকর (রাঃ) আহমাস গোত্রের যায়নাব নান্মী জনৈক মহিলার নিকট গমন করলেন। তিনি গিয়ে দেখতে পেলেন, মহিলাটি কথাবার্তা বলছেনা। তিনি (লোকজনকে) জিজ্ঞাসা করলেন, মহিলাটির এ অবস্থা কেন, কথাবার্তা বলছে না কেন? তারা তাঁকে জানালেন, এ মহিলা নীরব থেকে থেকে হাজ্জ (হজ্জ) পালন করে আসছেন। আবূ বকর (রাঃ) তাঁকে বললেন, কথা বল কেন না ইহা হালাল নয়। ইহা জাহেলিয়্যাত যুগের কাজ। তখন মহিলাটি কথাবার্তা বলল, জিজ্ঞাসা করল, আপনি কে? আবূ বকর (রাঃ) উত্তরে বললেন, আমি একজন মুহাজির ব্যাক্তি। মহিলাটি জিজ্ঞাসা করল, আপনি কোন গোত্রের মুহাজির? আবূ বকর (রাঃ) বললেন, কুরাইশ গোত্রের। মহিলাটি জিজ্ঞাসা করলেন, কোন কুরাইশের কোন শাখার আপনি? আবু বকর (রাঃ) বললেন, তুমি তো অত্যধিক উত্তম প্রশ্নকারিণী। আমি আবূ বকর। তখন মহিলাটি তাঁকে জিজ্ঞাসা করল, জাহেলিয়্যা যুগের পর যে উত্তম দ্বীন ও কল্যাণময় জীবন বিধান আল্লাহ আমাদেরকে দান করেছেন সে দ্বীনের উপর আমরা কতদিন সঠিকভাবে টিকে থাকতে পারব? আবু বকর (রাঃ) বললেন, যতদিন তোমাদের ইমামগণ তোমাদেরকে নিয়ে দ্বীনের উপর অবিচল থাকবেন। মহিলা জিজ্ঞাসা করল, ইমামগণ কারা? আবূ বকর (রাঃ) বললেন, তোমাদের গোত্রে ও সামাজে এমন সম্ভ্রান্ত ও নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তিবর্গ কি দেখনি। যারা আদেশ করলে সকলেই তা মেনে চলে। মহিলা উত্তর দিল, হ্যাঁ। আবূ বকর (রাঃ) বললেন, এরাই হলেন জনগণের ইমাম। [বুখারী: ৩৮৩৪]
ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহঃ) হাদীস পরবর্তী টীকায় বলেছেন, ‘এখানে জাহেলী কর্মকাণ্ড দ্বারা উদ্দেশ্য হলো সেসকল কাজ যা শুধুমাত্র জাহেলী যুগের মানুষরাই করতো এবং ইসলাম যেগুলোকে সমর্থন করেনি।’ ইক্বতিদাউস সিরাতিল মুসতাকীম, ১/৩২৭
আর ইসলাম যা বিধিবদ্ধ করেছে তা অবশ্য পালনীয়, যদিও তারা সেটা পালন করে থাকুক না কেন। যেমন: সফা ও মারওয়ার মাঝে সাঈ করা সহ হজ্বের বিভিন্ন কার্যাবলি।
তৃতীয় মূলনীতি: বিদআতের দিকে পরিচালনাকারী কার্যাবলি।
মূলনীতির বিশ্লেষণ: যে কাজগুলো বিদআতের দিকে পরিচালিত করে সেগুলো সম্পাদন করলেও বিদআত হবে। এই মূলনীতির অধীনে মোট পাঁচটি কায়েদা রয়েছে (১৯,২০,২১,২২,২৩ নং কায়েদাসমূহ)।
কায়েদা ১৯. শরীয়ত কর্তৃক আদিষ্ট কোনো কাজ যদি এমনভাবে করা হয় যা বাস্তবে তা থেকে ভিন্ন মনে হয়, তবে তা বিদআতের সাথে সম্পৃক্ত।
কায়েদার ব্যাখ্যা ও উদাহরণ: এই কায়েদাটি শরীয়ত কর্তৃক উদ্দিষ্ট ওয়াজিব ও মানদূব বিষয়ের সাথে নির্দিষ্ট, যার পাঁচটি ধরণ রয়েছে।
ক. নফল কাজকে সুন্নতে রতিবাহ ভেবে ভুল করা। যেমন মসজিদে মসজিদে জামাতের সাথে নফল সলাত আদায় করা।
খ. সুন্নতকে ফরয ভেবে ভুল করা। যেমন প্রত্যেক জুমাবারের ফজরের সলাতে সূরা সাজদাহ ও সূরা দাহর-কে আবশ্যক করে নেওয়া।
গ. প্রশস্ত ইবাদাতকে সময় বা স্থান বা গুণ বা পদ্ধতির সাথে নির্দিষ্ট করে নেওয়া। [নবম কায়েদায় এর আলোচনা গত হয়েছে]
ঘ. শরয়ী আমলের সাথে অতিরিক্ত আমল যুক্ত করে শরয়ী আমলের পদ্ধতি সেই অতিরিক্ত আমলের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা। এর ফলে অতিরিক্ত আমলটাকে যেন শরয়ী আমলের অংশ বলে মনে হয়। উদাহরণ: পশু যবেহ করা অথবা দাস আযাদ করার সময় বলা, ‘হে আল্লাহ! এটা তোমার পক্ষ থেকে আর তোমার প্রতি’, তাওয়াফের সময় কুরআন তিলাওয়াত করা ইত্যাদি।
তবে যদি কেউ কোনো শরয়ী ইবাদাত করে এবং সেই সাথে অন্য কোনো ইবাদাত করে, কিন্তু তার মনে যদি উভয় ইবাদাতের মাঝে সংমিশ্রণ ঘটানোর কোনো ইচ্ছা না থাকে তবে সেক্ষেত্রে কোনো সমস্যা নেই।
ঙ. প্রতি সপ্তাহে বা প্রতি মাসে বা প্রতি বছরে নিয়মিত সকলে একত্রিত হওয়া (শরয়ী একত্রিত হওয়া ব্যতীত)। ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহঃ) বলেন, ‘কেননা এটা যেন সলাত, জুমুআ, দুই ঈদ ও হজ্জের ন্যায়। এটা বিদআত।’ [ইক্বতিদাউস সিরাতিল মুসতাকীম, ২/৬৩০]
কায়েদা ২০. কোনো জায়েয কাজ ওয়াজিব হওয়ার বিশ্বাসে সম্পাদন করা বিদআত।
উদাহরণ: মসজিদ কারুকার্য খচিত করা; কারণ অনেকেই মনে করে যে মসজিদে কারুকার্য করার মাধ্যমে আল্লাহর ঘরকে (সম্মান) উঁচু করা হয়।
কায়েদার ব্যাখ্যা: যে সকল মুবাহ (বৈধ) ও মাকরূহ কাজ (অপছন্দীয় কিন্তু করলে গুনাহ নেই) শরীয়ত কর্তৃক অনুমোদিত, তা যদি শরীয়ত কর্তৃক উদ্দিষ্ট মনে করে করা হয়; এই কায়েদাটি সেক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
আবূ শামাহ (রহঃ) বলে, ‘শরীয়ত সম্মত নয় এমন কোন কাজকে যদি কেউ শরীয়ত সম্মত মনে করে সম্পাদন করে তবে সেটা দ্বীনের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি, বিদআত এবং আল্লাহর উপর মিথ্যা চাপানোর নামান্তর।’ [আল-বায়িস: ২০,২১]
কায়েদা ২১. যদি অনুসরনীয় আলেমদের থেকে কোন পাপকাজ প্রকাশ পায় এবং এর প্রতিবাদ না করে বরং সাধারণ জনগণ এই পাপকাজটাকেই দ্বীনের অংশ মনে করে বসে তবে এটা বিদআতের সাথে সম্পৃক্ত।
কারণ, সাধারণ জনগণ আলেমের কথার তুলনায় তার কাজকেই বেশি প্রাধান্য দেয় এই যুক্তিতে যে, যদি একাজটি নিষিদ্ধ কিংবা মাকরূহ হতোই তবে স্বয়ং আলেম বিরত থাকতেন।
উদাহরণ: এই কায়েদাটি এমন পাপকাজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যদি সে কাজটি পাপকাজ না ভেবে করা হয়। ইমাম শাতেবী (রহঃ) বলেন, ‘সালাফগণ বলে থাকেন যে, তিনটি বিষয় দ্বীনকে ধ্বংস করে দেয়: আলেমের পদস্খলন, কুরআন নিয়ে মুনাফিকের তর্ক এবং পথভ্রষ্ট ইমাম’।
এছাড়াও বলা হয় যে, ‘আলেমের পদস্খলন মানে আলামের (দুনিয়ার) পদস্খলন’। [মাজমূ আল-ফাতাওয়া, ২০/২৭৪]
কায়েদা ২২. যদি সাধারণ জনগণের মাঝে পাপকাজ ছড়িয়ে পড়ে এবং অনুসরনীয় আলেমগণ সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করে, এমনকি জনগণ যদি এই বিশ্বাস ধারণ করে যে, এই পাপকাজে কোন সমস্যা নেই তবে সেটা বিদআতের সাথে সম্পৃক্ত।
ইমাম শাতেবী (রহঃ) বলেন, ‘প্রতিবাদ করতে হবে এমন বিষয়েও যদি প্রতিবাদ না করা হয় এবং সেটা যদি সমাজে ছড়িয়ে পড়ে, তবে সাধারণ জনগণ সেটাকে জায়েয কাজ হিসেবেই ধরে নিবে’। [আল-ইতসাম, ২/১০১]
উদাহরণ: ক. সুদ।
কায়েদা ২৩. একটি বিদআতি কাজ করার ফলে অন্যান্য আনুষাংগিক যে ইবাদাত বা আচার-আচরণ তৈরি হয় সেগুলো বিদআতের সাথে সম্পৃক্ত। কারণ। বিদআতের উপর যার জন্ম সেটা আদতে বিদআত।
উদাহরণ: নিসফে শাবানের রজনীতে অতিরিক্ত লাইটিং ব্যবস্থা, মসজিদ সাজানো, হালুয়া খাওয়া, বেশি বেশি দান করা ইত্যাদি যাবতীয় কাজই বিদআত। কারণ এর মূল হলো বিদআত।
কায়েদার ব্যখ্যা: এই কায়েদাটি সেসকল বিষয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যেগুলো একটি মূল বিদআতের ফলাফল হিসেবে প্রকাশ পেয়ে থাকে।
পরিশেষে, বিদআতের ক্ষেত্র মূলত পাঁচটি:
১. বিশ্বাস
২. ইবাদাত ও নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম
৩. সংস্কৃতি ও লেনদেন
৪. পাপকাজ ও নিষিদ্ধ কার্যাবলি
৫. কাফিরদের সাদৃশ্য গ্রহণ
Thanks a lot.