আসবাবুন নুযূল

আসবাবুন নুযূল

সংকলক: ড. মুহাম্মাদ আহমাদ মুইয
উসতাযুল কুরআন, কিং আব্দুল আযীয ইউনিভার্সিটি, সৌদি আরব
সংক্ষিপ্ত অনুবাদ: সাব্বির রায়হান বিন আহসান হাবিব
[অধ্যয়নরত, কিং আব্দুল আযীয বিশ্ববিদ্যালয় কো-অর্ডিনেটর, আল-ইলম একাডেমী]

সালাফ আলেমগণ উলূমুল কুরআন বা কুরআন বুঝার মূলনীতির অনিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে আসবাবুন নুযূল জানার ব্যাপারে যথাযথ গুরুত্ব দিয়েছেন। যার অন্যতম একটি উদ্যোগ হচ্ছে আসবাবুন নুযূল সম্পর্কে স্বতন্ত্র লেখনী।

আসবাবুন নুযূল জানার ক্ষেত্রে কিসের উপর নির্ভর করা হয়:
আসবাবুন নুযূল জানার ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখা হয় যে, বর্ণনাটি রাসূল ﷺ অথবা সাহাবা থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত কী না। কারণ কোনো সাহাবা যদি স্পষ্টভাবে আসবাবুন নুযূল সম্পর্কে সংবাদ দেয় তবে সেটা তার রায় বা মতামত নয়, বরং সেটা মারফূ-র (নাবী ﷺ এর সূত্রে বর্ণিত) পর্যায়ভুক্ত বলে গণ্য হয়। আল্লামা ওয়াহিদী (রহঃ) বলেন:
“কুরআন অবতীর্ণ হতে দেখেছে, অবতীর্ণের কারণ সম্পর্কে অবগত আছে এবং এর কারণ খুঁজেছে এমন ব্যক্তিদের (সাহাবাগণ) থেকে রেওয়াইয়াত ও শ্রুতি ব্যতীত আসবাবুন নুযূল সম্পর্কে কোনো কথা/বক্তব্য গ্রহণ করা হবে না।” [আল-ইতকান ফী উলূমিল কুরআন, সুয়ূতী: ১/১১৪]
এটাই সালাফদের পথ। এটাই তাদের নীতি। আসবাবুন নুযূল এর ব্যাপারে অসাব্যস্ত কোনো বিষয়ে কথা বলা থেকে তারা দূরে থাকতেন। মুহাম্মাদ বিন সীরীন (রহঃ) বলেন, ‘আমি উবাইদাহকে কুরআনের একটি আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি উত্তরে বললেন:
“তুমি আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলো। কুরআন নাযিলের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে যারা জানতেন তারা গত হয়ে গিয়েছেন (তিনি এর দ্বারা সাহাবাগণকে উদ্দেশ্য করেছেন)”। [আসবাবুন নুযূল, ওয়াহিদী: ০৯]
ইমাম সুয়ূতী (রহঃ) এর নিকট শর্তসাপেক্ষে আসবাবুন নুযূলের ক্ষেত্রে তাবেঈদের কউল গ্রহণ করা যাবে।

আসবাবুন নুযূল কী?
আসবাবুন নুযূল মূলত দুটি বিষয়ে সীমাবদ্ধ:
১. কোনো ঘটনার প্রেক্ষিতে কুরআনের আয়াত নাযিল হওয়া। যেমন ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: যখন এ আয়াত وَأَنْذِرْ عَشِيرَتَكَ الأَقْرَبِينَ অবতীর্ণ হল, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফা (পর্বতে) আরোহণ করে ’ইয়া সাবাহাহ, বলে সকলকে ডাক দিলেন। কুরাইশগণ তাঁর কাছে সমবেত হয়ে বলল, তোমার ব্যাপার কী? তিনি বললেন, তোমরা বল তো, আমি যদি তোমাদের বলি যে, শত্রুবাহিনী সকাল বা সন্ধ্যায় তোমাদের উপর আক্রমণ করতে উদ্যত; তবে কি তোমরা আমার এ কথা বিশ্বাস করবে? তারা বলল, অবশ্যই। তিনি বললেন, আমি তো তোমাদের জন্য এক আসন্ন কঠিন শাস্তির ভয় প্রদর্শনকারী। একথা শুনে আবূ লাহাব বলল, তোমার ধ্বংস হোক। এই জন্যই কি আমাদেরকে সমবেত করেছিলে? তখন আল্লাহ্ অবতীর্ণ করেনঃ ‏تَبَّتْ يَدَا أَبِي لَهَبٍ “আবূ লাহাবের দু’হাত ধ্বংস হোক।” [বুখারী: ৪৮০১]
২. রাসূল ﷺ কোনো বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হওয়ার পর তার বর্ণনায় কুরআনের আয়াত নাযিল হওয়া। যেমনটি ঘটেছিল খওলাহ বিনতে সালাবার সাথে, যখন তার স্বামী আউস বিন সামিত তার সাথে যিহার করেছিল। খওলাহ তখন রাসূল ﷺ এর কাছে অভিযোগ নিয়ে আসেন। ’আয়িশাহ্ (রাঃ) বলেছেন, বরকতময় সেই সত্তা যাঁর শরবণশক্তি সব কিছুতে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে। আমি সা’লাবার কন্যা খাওলা (রাঃ)-এর কিছু কথা শুনলাম এবং কিছু কতা আমার অজ্ঞাত থেকে যায়। তিনি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট তার স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করেন। তিনি বলেন, হে আল্লাহর রসূল! সে আমার যৌবন উপভোগ করেছে এবং আমি আমার পেট থেকে তাকে অনেক সন্তান উপহার দিয়েছি। অবশেষে আমি যখন বার্ধক্যে উপনীত হলাম এবং সন্তানদানে অক্ষম হলাম, তখন সে আমার সাথে যিহার করেছে। হে আল্লাহ্! আমি তোমার নিকটে আমার অভিযোগ পেশ করছি। অতঃপর বেশি সময়ে অতিবাহিত না হতেই জিবরীল (আঃ) এ আয়াতগুলো নিয়ে অবতরণ করলেন (অনুবাদ) ’’আল্লাহ্ অবশ্যই শুনেছেন সেই নারীর কথা, যে নিজের স্বামীর বিষয়ে তোমার সাথে বাদানুবাদ করছে এবং আল্লাহর নিকটও ফরিয়াদ করছে…’’ (সূরা মুজাদালাঃ ১)। [সহীহ, ইবনে মাজাহ: ১৮৮]
একটি লক্ষণীয় বিষয়: এর মানে এই নয় যে প্রতিটি আয়াতেরই অবতীর্ণ হওয়ার পেছনে কারণ পাওয়া যাবে। পুরো কুরআন ঘটনা ও প্রশ্নের উত্তরে নাযিল হয়নি; বরং কুরআনের এমনও অংশ রয়েছে যা ইবতিদাঈ বা প্রারম্ভিক; যেখানে আকীদা, ঈমান, ইসলামের আবশ্যকীয় বিষয়াবলী ও শরীয়ত সংক্রান্ত আলোচনা এসেছে। ইমাম আল-জা‘বারী (রহঃ) বলেন:
“কুরআন দুইভাগে নাযিল হয়ে – ১. প্রারম্ভিক এবং ২. কোনো ঘটনা অথবা প্রশ্নের প্রেক্ষিতে”। [মাবাহিস ফী উলূমিল কুরআন, মান্নাউল ক্বত্তান: ৭৮]

আসবাবুন নুযূলের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি:
আসবাবুন নুযূলের ক্ষেত্রকে প্রশস্ত করে এর মাঝে অতীত ঘটনাবলীর অন্তর্ভুক্তি এক ধরনের বাড়াবাড়ি। (যেমন: কেউ কেউ বলে যে, সূরা ফীল নাযিল হওয়ার কারণ হলো হাবশী বাহিনীর মক্কা আসার ঘটনা; অথচ এটা উক্ত সূরা অবতীর্ণ হওয়ার কারণ নয়।)

আসবাবুন নুযূল জানার উপকারিতা:
১. বিভিন্ন বিধান অবতীর্ণের পেছনের হিকমাহ বর্ণনা।
২. কুরআন বুঝার জন্য আসবাবুন নুযূল জানা একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপায়। ইমাম আল-ওয়াহিদী (রহঃ) বলেন,
“কোনো আয়াতের পেছনের ঘটনা ও অবতীর্ণের কারণ জানা ব্যতীত তার তাফসীর জানা সম্ভব নয়”। [আল-ইতকান ফী উলূমিল কুরআন, সুয়ূতী: ১/১০৮]
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহঃ) বলেন:
“আসবাবুন নুযূল জানার ফলে কুরআনের আয়াতের মর্মার্থ বোঝা সহজ হয়”। [মুক্বদ্দিমাহ ফী উসূলিত তাফসীর, ইবনে তাইমিয়্যাহ: ১৬]
৩. আসবাবুন নুযূলের মাধ্যমে আয়াত কার উপর বা প্রেক্ষিতে নাযিল হয়েছে সেটা জানা যায়, যাতে করে কেউ অন্যের বা ভিন্ন ঘটনার উপর এর প্রয়োগ করতে না পারে।

আসবাবুন নুযূলের বাক্যরূপ:
আসবাবুন নুযূলের বাক্যরূপ দুভাবে হতে পারে:
১. সরীহ (صريح) বা সুস্পষ্টভাবে আয়াত নাযিলের কারণ বুঝাবে। যেমন কোনো বর্ণনাকারী যদি বলে,
– ‘سبب نزول هذه الآية كذا’ (এই আয়াত নাযিলের কারণ হলো এটা) অথবা
– ঘটনা উল্লেখের পর যদি অতঃপর বুঝানোর ফা’ হরফ আসে তবে; যেমন ‘سئل رسول الله صلى الله عليه وسلم عن كذا فنزلت الآية’ (রাসূল ﷺ কে অমুল বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে/ঘটনা ঘটলে এই আয়াতটি নাযিল হয়);
এ দুটি হচ্ছে আসবাবুন নুযূল বুঝানোর সুস্পষ্ট বা সরীহ বাক্যরূপ।
২. আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার কারণ বুঝানোর সম্ভাবনা রাখে এমন বাক্য। যেমন বর্ণনাকারী যদি বলে, ‘نزلت هذه الآية في كذا’ (আয়াতটি অমুক বিষয়ে অবতীর্ণ), তবে এর দ্বারা দুটো বিষয়ের উদ্দেশ্য হতে পারে:
ক. এটি আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার কারণ
খ. অথবা এটি আয়াতের অর্থের অন্তর্ভুক্ত
একইভাবে, যদি কোনো রাবী বলে যে, ‘আমি মনে করি এই আয়াতটি অমুক প্রেক্ষাপটে নাযিল হয়েছে’ অথবা ‘আমি মনে করি না যে আয়াতটি এই বিষয়ে ছাড়া অন্য কোনো প্রেক্ষাপটে নাযিল হয়েছে’; তবে এর দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে বর্ণনাকারী প্রেক্ষাপটের বিষয়ে সুনিশ্চিত নন।

একটি আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপটে একাধিক বর্ণনা:
একটি আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপটে একাধিক বর্ণনা বা রেওয়ায়েত আসতে পারে। এমতাবস্থায় একজন মুফাসসিরের অবস্থান হবে নিম্নরূপ:
১. যদি বর্ণিত বাক্যরূপগুলো সরীহ বা আসবাবুন নুযূলের দিকে সুস্পষ্টভাবে ইঙ্গিত না করে তবে বুঝতে হবে এগুলো দ্বারা আয়াতটির তাফসীর উদ্দেশ্য, প্রেক্ষাপট বর্ণনা উদ্দেশ্য নয়। তবে বর্ণনাগুলোর মধ্যে কোনো একটিতে যদি অবতীর্ণের কারণ বর্ণনার ইঙ্গিত পাওয়া যায় (ক্বরিনাহ) তবে সেটিকে শুধুমাত্র কারণ হিসেবে গণ্য করা হবে, আর বাকিগুলো তাফসীর হিসেবে গণ্য হবে।
২. যদি আসবাবুন নুযূল বর্ণনার বাক্যগুলোর একটি সরীহ বা সুপষ্ট না হয় এবং অন্যটি সুস্পষ্টভাবে আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে তবে সুস্পষ্টটাই কারণ হিসেবে গণ্য হবে।
৩. যদি বর্ণনা একধিক হয় এবং সবগুলোই আয়াত অবতীর্ণের প্রেক্ষাপটের দিকে ইঙ্গিত করে এবং যেকোনো একটির সানাদ সহীহ হয়, তবে বিশুদ্ধ বর্ণনাই গ্রহণযোগ্য।
৪. যদি বিশুদ্ধতার দিক সকল বর্ণনাই সম্পর্যায়ের হয় এবং যেকোনো একটির মাঝে তারজীহ দেওয়া সুযোগ থাকে (যেমন: ঘটনাবহুল বর্ণনা অথবা তুলনামূলক বেশি সহীহ) তবে প্রণিধানযোগ্য বর্ণনাই আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট হিসেবে ধর্তব্য হবে।

একটি শানে নুযূল, একাধিক আয়াত:
কখনো কখনো একই প্রেক্ষাপটে একাধিক আয়াত নাযিল হতে পারে। যেমন:
– উম্মু সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আল্লাহ্ তা’আলাকে হিজরতের বিষয়ে মেয়েদের নিয়ে কিছু বলতে শুনলাম না। আল্লাহ্ তা’আলা তখন নাযিল করেনঃ
– إِنِّي لاَ أُضِيعُ عَمَلَ عَامِلٍ مِنْكُمْ مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى بَعْضُكُمْ مِنْ بَعْضٍ
আমি তোমাদের মধ্যে কোন কর্মনিষ্ঠা পুরুষ অথবা নারীর কর্ম বিফল করি না। তোমরা একে অপরের অংশ …… আয়াতের শেষ পর্যন্ত। (সূরা আল-ই-ইমরান ৩ঃ ১৯৫)। [সহীহ। তিরমিযী: ৩০২৩]
– উম্মু উমারা আল আনসারিয়্যা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, তিনি একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে বললেনঃ সবই তো দেখছি পুরুষদের জন্য মেয়েদের জন্য কিছুর উল্লেখ হতে দেখতে পাচ্ছি না। তখন এই আয়াত নাযিল হয়ঃ
– ‏إن الْمُسْلِمِينَ وَالْمُسْلِمَاتِ وَالْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ
(আবু ঈসা বলেন)হাদীসটি হাসান-গারীব। এই সূত্রেই আমরা এটি সম্পর্কে জানি। সহীহ, তিরমিজী হাদিস নম্বরঃ ৩২১১ [আল মাদানী প্রকাশনী]
– উম্মু সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ পুরুষরা জিহাদ করে অথচ মহিলারা জিহাদ করতে পারে না। আর আমাদের জন্য (পুরুষের তুলনায়) মীরাছের অর্ধেক হিস্যা মাত্র। তখন আল্লাহ্ তা’আলা নাযিল করেনঃ
– ‏وَلاَ تَتَمَنَّوْا مَا فَضَّلَ اللَّهُ بِهِ بَعْضَكُمْ عَلَى بَعْضٍ
যা দিয়ে আল্লাহ তোমাদের কতককে কতকের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন, তোমরা তার লোভ করবে না। (৪ঃ ৩২)। সহীহ, তিরমিযী: ৩০২২।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *