ড. জামীল আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ আল-মিসরী
(সহকারী অধ্যাপক, কুল্লিয়াতুত দাওয়াহ ওয়া উসূলুদ দ্বীন, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়)
সংক্ষিপ্ত অনুবাদ: সাব্বির রায়হান বিন আহসান হাবিব
[অধ্যয়নরত, কিং আব্দুল আযীয বিশ্ববিদ্যালয় কো-অর্ডিনেটর, আল-ইলম একাডেমী]
স্বভাবগতভাবে ইসলাম মানবজীবনের যাবতীয় সমস্যার সমাধান দিয়ে আসছে। জীবনের এমন কোনো দিক কিংবা এমন কোনো বাস্তবতা নেই যা ইসলাম ছেড়ে দিয়েছে কিংবা সে সম্পর্কে ইসলামে কোনো সমাধান নেই। ইসলাম মানবজীবনের অর্থনৈতিক বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে ফিতরাত-সমর্থিত এমন ভিত্তি স্থাপন করেছে, যার উপর মানবজীবনের একটি সংশোধনোর্ধ্ব স্থিতিশীল অর্থনৈতিক ভবন দাঁড়িয়ে আছে। এ ধর্ম মানুষকে ভ্রাতৃত্বের শৃংখলে আবদ্ধ করতঃ অনধিকার চর্চা ও লুণ্ঠনের মনোভাবকে এমন বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে ভূলুণ্ঠিত করেছে যা ইসলামী আকীদার অন্তস্তল থেকে উৎসারিত, যে আকীদা অর্থনৈতিক লেনদেনকে গণ্য করে থাকে জীবন রক্ষার অন্যতম একটি মাধ্যম হিসেবে।
ইসলামী অর্থনীতির উল্লেখযোগ্য কিছু মূলনীতি নিম্নে প্রদত্ত হলো:
– আল্লাহ সকল সম্পদের একচ্ছত্র মালিক। মানুষ এই সম্পদ দখলসূত্রে সাময়িক ব্যবহারকারী মাত্র।
– সমাজের প্রত্যেক সদস্যের জন্য অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের মতো প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের নিশ্চয়তা দেওয়া আবশ্যক।
– সর্বাবস্থায় অন্যের সম্পদে অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ করা হারাম। যেমন: ঘুষ, চুরি, ধোঁকা ইত্যাদি।
– ইসলামে সুদ হারাম। ইসলাম সুদের স্থলে কর্যে হাসানাহ-কে হালাল স্বীকৃতি দিয়েছে। সুদখোরকে ইসলামে আল্লাহ ﷻ ও রাসূলের ﷺ সাথে বিদ্রোহকারী হিসেবে গণ্য করা হয়। কারণ, একজন সুদখোর অন্যের দুরাবস্থার সুযোগ গ্রহণ করে থাকে। এভাবে সে মানুষের মাঝে হিংসার বীজ বপন করে।
– মজুতদারি, লোভ, সুবিধা-ভোগ ও অথবা চাঁদাবাজি করা হারাম।
– সম্পদ শুধু বিত্তশালীদের মাঝেই আবর্তিত হওয়া নিষেধ। একারণেই ইসলাম যেকোন ধরণের শ্রেণীতন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা দিয়েছে এবং হিংসা ও যুলমের ঝঞ্ঝাটমুক্ত ইনসাফপূর্ণ সমাজব্যবস্থার ডাক দিয়েছে। কোনো সম্পদশালীকে নিঃস্ব করে দেওয়া ইসলামের উদ্দেশ্য নয়; বরং, ইসলাম দরিদ্রদের হাত ধরে তাকে জীবনধারণের উপযুক্ত স্তরে উন্নীত করতে চায়। এভাবেই সমাজ ধনী-গরীব নির্বিশেষে ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্বের পথে পরিচালিত হয়, যেখানে নেই কোনো দ্বন্দ্ব কিংবা বিদ্বেষ।
– অন্যের উপকারে সম্পদ ব্যয় করার প্রতি উৎসাহ প্রদান এবং প্রয়োজনের সময় তা বাধ্যতামূলককরণ।
– এছাড়াও ইসলাম অপব্যয়ী ও নির্বোধ লোকদের সম্পদ আটকে রাখার অনুমোদন দিয়েছে। অতএব, সুন্দরভাবে অন্যের সম্পদের দায়িত্ব গ্রহণ করা প্রতিটি মানুষের একান্ত কর্তব্য।
– উত্তরাধিকার ও অসিয়তনামা ইসলামে অনুমোদিত; যাতে ব্যক্তির ধনসম্পদ গুটিকয়েক মানুষের হস্তগত না হয়ে উপযুক্ত স্থানে পৌঁছাতে পারে।
– ইসলাম অর্থনীতি ও দ্বীনের মাঝে পার্থক্য করেনি। মানবজাতিকে একমাত্র আল্লাহর ইবাদাতের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। আর জমিনে যা কিছু ছড়িয়ে আছে তা মানুষের ইবাদাতের সহায়ক। ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহঃ) বলেন: “আসলে আল্লাহ ﷻ সম্পদ সৃষ্টি করেছেন তার ইবাদাতের সহায়ক স্বরূপ। কেননা সৃষ্টির উদ্দেশ্য হলো একমাত্র তাঁর ইবাদাত করা।” [আস-সিয়াসাতুশ শারীয়াহ ফী ইসলাহির রা‘ঈ ওয়ার রাইয়্যাহ, পৃষ্ঠা: ৫৬]
– ইসলাম রিযক অন্বেষণের প্রতি উৎসাহ ও একক মালিকানাকে বৈধতা দিয়েছে এবং হালাল-হারামের বিস্তারিত বর্ণনা পেশ করেছে। ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র (অর্থনৈতিক অমুখাপেক্ষিতা) আত্মিক স্থিতিশীলতার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: মানবজাতিকে সামগ্রিকভবে পৃথিবী আবাদ করার যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সেই দায়িত্বের মাঝেও নিজের জন্য একক অনুভূতি ও ব্যক্তিগত জবাবদিহিতার জায়গা রাখা।
একজন মুসলিম তিনটি পদ্ধতিতে তার মালিকানাধীন সম্পদ ব্যয় করে থাকে:
১. হয়তো সে মনের খেয়ালখুশি মতো ব্যয় কিংবা অপচয় না করে হালাল উপায়ে ও হালাল স্থানে ব্যয় করে; কারণ ইসলাম জীবনধারণের ক্ষেত্রে মধ্যমন্থা অবলম্বন করা অত্যাবশ্যক করেছে; মানুষ ও তার সুন্দর জীবনধারণের মাঝে কোনো প্রকার শিথিলতা প্রদর্শন করেনি। আল্লাহ ﷻ বলেন:
وَ لَا تَجۡعَلۡ یَدَکَ مَغۡلُوۡلَۃً اِلٰی عُنُقِکَ وَ لَا تَبۡسُطۡهَا کُلَّ الۡبَسۡطِ فَتَقۡعُدَ مَلُوۡمًا مَّحۡسُوۡرًا
তুমি বদ্ধমুষ্টি হয়োনা এবং একেবারে মুক্ত হস্তও হয়োনা; তাহলে তুমি নিন্দিত ও নিঃস্ব হবে। [আল-ইসরা: ২৯]
এছাড়াও আল্লাহ ﷻ মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন:
وَ الَّذِیۡنَ اِذَاۤ اَنۡفَقُوۡا لَمۡ یُسۡرِفُوۡا وَ لَمۡ یَقۡتُرُوۡا وَ کَانَ بَیۡنَ ذٰلِکَ قَوَامًا
আর যখন তারা ব্যয় করে তখন তারা অপব্যয় করেনা এবং কার্পন্যও করেনা; বরং তারা আছে এতদুভয়ের মাঝে মধ্যম পন্থায়। [আল-ফুরকান: ৫৭]
২. অথবা সে হয়তো তার সম্পদ কোনো ব্যবসাক্ষেত্র কিংবা শিল্প-বাণিজ্যে কাজে লাগায় এবং এর মাধ্যমে হালাল লভ্যাংশ ভোগ করে।
৩. অথবা হয়তো সে হয়তো তার সম্পদ জমা করে।
এখানে উল্লেখ্য যে, ইসলামে সম্পদ জমিয়ে রাখা অপছন্দনীয়। কেউ যদি সম্পদ জমিয়ে রাখতে চায় তবে তাকে শতকরা আড়াই টাকা করে বাৎসরিক হারে আট শ্রেণির নির্দিষ্ট মানুষের মাঝে যাকাত দিতে হবে। আল্লাহ ﷻ বলেন:
وَ الَّذِیۡنَ فِیۡۤ اَمۡوَالِهِمۡ حَقٌّ مَّعۡلُوۡمٌ
যাদের ধন-সম্পদে একটা সুবিদিত অধিকার আছে…। [আল-মা‘আরিজ: ২৪]
অন্য অর্থে, আমরা দেখি যে, ইসলাম সর্বাবস্থায় ব্যক্তিতান্ত্রিক পুঁজিবাদ, কমিউনিজম ও সমাজতন্ত্র থেকে দূরত্ব বজায় রেখে আসছে। কারণ, একদিকে যেভাবে পুঁজিবাদ মানুষকে বাধাহীন স্বাধীনতা প্রদান করে, অন্যদিকে কমিউনিজম ও সমাজতন্ত্র মানুষকে মনে করে আলমারি অথবা চাকার দাঁতস্বরূপ, যার কোনো গুরুত্ব কিংবা মূল্য নেই এবং তা একক মালিকানাকে অস্বীকার করে।
এদিকে ইসলাম এমন অর্থনৈতিক অবকাঠামো স্থাপন করেছে যা আয়-ব্যয় উভয়ের শুদ্ধতা নিশ্চিত করতঃ সর্বোপরি সকলের জন্য কল্যাণকর পদ্ধতি বাতলে দেয়।
একসময় মুসলমানদের মাঝে স্থবিরতা বিরাজ শুরু করেছিল। অন্যান্য ক্ষেত্রের ন্যায় অর্থনীতিতেও পশ্চাদ্গামিতা পরিলক্ষিত হলো। দারিদ্রতা, রোগ-ব্যাধি, নিরক্ষরতা ও মূর্খতার হার বেড়েই চলছিল। অল্পে তুষ্টির নামে মানুষ একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকতো সাহায্যের আশায়। কিন্তু মুসলিম সমাজে সামাজিক দায়িত্ববোধের চেতনা তখনও বর্তমান ছিল। মোটকথা, সেসময়কার পশ্চাৎপদ মুসলিম সমাজে একাধারে দারিদ্রতা, অল্পে তুষ্টি ও অন্যকে অগ্রাধিকার দেওয়ার মনোভাব ইত্যাদি সবকিছুই বর্তমান ছিল। সেচ ও কৃষিকাজে অবহেলা করার কারণে জনসাধারণের মূল উৎপাদন ক্ষেত্র থেকে উল্লেখযোগ্য কোন অর্থের জোগান আসছিল না। রাজপথ অবহেলা আর অনিরাপত্তায় পড়ে ছিল। কিছু দুষ্টুচক্র ও লুটতরাজ বাহিনী এই সুযোগে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও মানুষের ঘরবাড়িতে লুটপাট চালাতো। গ্রাম্য বেদুইনরা পল্লী এলাকাগুলোতে হামলা করে ফসলাদি লুটে নিতে থাকে এবং হজ্ব ও ব্যবসায়ী কাফেলাকে আক্রমণ করার জন্য পথিমধ্যে ওঁত পেতে বসে থাকতো। মুসলমানদেরকে নিরাপত্তাহীনতা আর ক্ষুধার যন্ত্রণার সম্মুখীন হতে হয়। এভাবে একপর্যায়ে মহামারী ছড়িয়ে পড়ে। এই ঘটনাগুলো ঘটে বিশেষত যখন বাণিজ্যিক রাস্তাগুলো ইসলামী রাষ্ট্রের বাইরে চলে যায় তখন।
এদিকে মুসলমানদের অবনতির ছায়ায় সংগোপনে পশ্চিমা উপনিবেশবাদ মুসলিম বিশ্বের উপর কর্তৃত্ব বিস্তার করতে থাকে। তারা তাদের নিজস্ব অর্থব্যবস্থা, এর পেছনে যৌক্তিকতা এবং নিজস্ব চিন্তাধারা চাপিয়ে দিতে থাকে। এর ফলে মানুষ স্বভাবতই ধারণা করতে লাগল যে, তাদের (পশ্চিমাদের) অর্থব্যবস্থা গ্রহণ না করলে বুঝি আর রিযকের দুয়ার উন্মুক্ত হবে না! প্রথমে মুসলমানরা হারাম খাওয়া শুরু করলো, এরপর হালাল-হারামের মাঝে আদৌ কোন পার্থক্য আছে কী না সেটাও ভুলতে লাগল। আস্তে আস্তে অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে, অধিকাংশ মুসলিম ইসলামের মৌলিক শিক্ষা থেকে দূরে সরে যেতে থাকলো।
ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো মুসলিম বিশ্বের অর্থনীতিতে যে প্রভাব রেখে গিয়েছিল নিম্নে তার কিছু উপস্থাপন করা হলো:
১. মুসলিম দেশগুলোর রিসোর্স বা উৎপাদন উৎসগুলোকে নিজেদের দখলে নিয়ে নেওয়া। এ লক্ষ্যে তারা বিদেশী পুঁজিবাদী গোষ্ঠীকে মুসলিম দেশগুলোতে আক্রমণ করতে উস্কে দেয়। অধিকাংশ বিদেশী কোম্পানীগুলো তখন এই উপনিবেশবাদের স্বার্থে কাজ করতে শুরু করে। ১৯ শতকের শেষের দিকে ইউরোপীয় স্বর্ণমুদ্রা ইনভেস্ট বা বিনিয়োগ করার লক্ষ্যে অনেকগুলো অর্থনৈতিক সংস্থা ও ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর ফলে উৎপাদিত পণ্যের বাজার উন্মুক্ত হয়ে যায়; বিশেষ করে ভোগবিলাসিতা, বিনোদন ইত্যাদি বিষয়কে কেন্দ্র করে মুসলিম বিশ্ব এক আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। মানুষ এখানে অজস্র অর্থ বিনিয়োগ করতে থাকে। বিষয়টি মুসলিম বিশ্বের অর্থনীতির জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।
এরপর, উপনিবেশিক শক্তি মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার ব্যবস্থাকে পশ্চিমাদের কর্তৃত্বে বন্দী করার লক্ষ্যে ঋণ দেওয়া শুরু করে। তারা বিত্তশালীদেরকে ঋণের মধ্যে ফেলে তাদের ধনসম্পদ, সহায়-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতঃ বিদেশী ব্যাংকের কাছে হস্তান্তর করার পাঁয়তারা করতে থাকে।
২. ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো ইসলামী দেশগুলোর বৈদেশিক এবং দেশীয় বাণিজ্যে একচেটিয়া কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতো। আলজেরিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, আফ্রিকা, তুর্কিস্তান সহ বিভিন্ন মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে তারা বাণিজ্যিক হেতুতে ইউরোপীয়দেরকে স্থায়ীভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করে দেয়। বিশেষ করে আরব দেশগুলোতে সহস্রাধিক ইউরোপীয় নাগরিক পাঠানো হয়, যাদের অধিকাংশই ইহুদী ধর্মালম্বী। তারা সেখানে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করে সেখানকার অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে; বিশেষ করে পশ্চিম আরবের অঞ্চলগুলোতে।
৩. উপনিবেশিক শক্তিগুলো মুসলিম বিশ্বের শিল্প-বাণিজ্যের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে পড়ল। সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে মুসলিমরা যেভাবে তাদের অনুসরণ করে আসছে, অর্থনৈতিকভাবেও যাতে তারা উপনিবেশবাদের পাবন্দী করে এটাই ছিল তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। এজন্য তারা মুসলমানদেরকে কৃষিকাজে ব্যস্ত রাখাই যথেষ্ট মনে করলো। তারা দুর্বল মুসলমানদেরকে এভাবে বুঝ দিল যে, ‘শিল্পক্ষেত্রে উন্নতি করার মতো পর্যায়ে তোমরা এখনো পৌঁছাওনি।’ কৃষিক্ষেত্রে তারা নির্ধারিত কিছুসংখ্যক ফসল উৎপাদনের উৎসাহ দিত (চাপসৃষ্টি করতো); যেমন: তুলা (মিশর), খেজুর (ইরাক), যাইতূনের তেল (তিউনিসিয়া ও মরক্কো), রাবার (ইন্দোনেশিয়া ও মালয়শিয়া), খেজুর গাছের তেল (নাইজেরিয়া) এবং আঙ্গুর (আলজেরিয়া)। এভাবে তারা পুরো বাজারে নিজেদের একচেটিয়া কর্তৃত্ব অক্ষুণ্ণ রাখতো।
তারা কৃষকদেরকে সুদের বিনিময়ে ঋণ প্রদান করতো। জনগণকে শোষণ করার জন্য গ্রামে গ্রামে কারবারী মহাজন, খাজাঞ্চী ও কিছু মদ্যপদেরকে নিযুক্ত করা হয়। এর ফলে মুসলিম দেশগুলো ইউরোপ-আমেরিকার বাজার মুখাপেক্ষী হয়ে যায়। তাদের কাছে উপর্যপুরি অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার কোনো শক্তিই আর অবশিষ্ট ছিল না।
৪. মুসলিম দেশগুলোতে বৃহৎ পরিমাণে খনিজ সম্পদ মজুদ আছে। বিশেষ করে আরব, নাইজেরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, আজারবাইজান ও ইরানে তেল, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও নাইজেরিয়ায় টিন, আলজাযিরা ও মৌরিতানিয়ায় লোহা এবং কাজাখিস্তানের তামা উল্লেখযোগ্য। উপনিবেশিক দেশগুলো চলে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ খনিজ সম্পদ উত্তোলনের কাজগুলো তাদের নিয়ন্ত্রিত কোম্পানি আঞ্জাম দিত এবং অর্জিত লভ্যাংশ নিজেদের দেশে পাঠিয়ে দিত।
৫. উপনিবেশবাদ মুসলিম সমাজে জমিদারী নীতি ও শ্রেনিতন্ত্রের পুঁজি জোগান দিয়ে আসছে। তারা খেটে খাওয়া সাধারণ মুসলিম জনগণকে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার মান থেকে বঞ্চিত করেছে। যার ফলে এতশত অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দুয়ার উন্মুক্ত থাকা সত্বেও অধিকাংশ মুসলিম দেশগুলোই আজ বিশ্বের তুলনামূলক দরিদ্র রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।
ড. নাবীল আত-ত্বউইল তার ‘আল-হিরমান ওয়াত তাখাল্লুফ ফী দিয়ারিল মুসলিমীন’ বইয়ের ৪৩ পৃষ্ঠায় বলেন:
‘আমি বিভিন্ন মুসলিম প্রধান দেশের বড়ো বড়ো শহরগুলোতে কিছুকাল অবস্থান করি। তন্মধ্যে নাইজেরিয়ার লাগোস (জনসংখ্যা ৪.৬ মিলিয়ন), মিশরের কায়রো (জনসংখ্যা প্রায় ৮ মিলিয়ন), পাকিস্তানের করাচী (জনসংখ্যা ৫ মিলিয়ন), ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা (৬ মিলিয়ন প্রায়) এবং বাংলাদেশের ঢাকা (জনসংখ্যা প্রায় ২.৫) উল্লেখযোগ্য। সেখানে আমি একটি বিষয় লক্ষ্য করি যে, মিলিওনিয়ার ও রিক্তহস্তের মানুষের মাঝে ভয়ংকর রকমের ব্যবধান বর্তমান। ……. প্রতিটি মুসলিম দেশেই এরকম পরিস্থিতি বিরাজ করছে। অথচ আল্লাহﷻ বলেছেন: মুমিন নর-নারী পরস্পর বন্ধুস্বরূপ [আত-তাওবাহ: ৭১]। নাবী ﷺ এর গৃহে সাধারণত কিছুই অবশিষ্ট থাকতো না। তিনি দুঃস্থ মানুষের মাঝে সবকিছু বণ্টন করে দিতেন। তাঁরﷺ খলিফাগণ সমাজের বিধবা ও মিসকীন মানুষদের কাছে কাঁধে করে খাদ্যের বোঝা নিয়ে যেতেন। উমর বিন আব্দুল আযীযের যুগে যাকাত কিংবা সাদাকাহ নেওয়ার মতো লোক পাওয়া যেত না। আব্বাসী শাসনামলে ধর্ম ও মাযহাব নির্বিশেষে সকলকে বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদান করা হতো।’
৬. উপনিবেশবাদ মুসলিম বিশ্বের মুদ্রাকে তাদের নিজদের মুদ্রার সাথে সংযুক্ত করে। যেমন, ইংরেজ-শাসিত দেশগুলোতে পাউন্ড স্টারলিং-এর প্রচলন ঘটে। অন্যদিকে ফ্রান্স অধ্যুষিত দেশগুলোতে ফ্রাঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে অনেক মুসলিম দেশে আমেরিকার ডলার ভিত্তিক লেনদেন হয়ে থাকে।
উপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলো মুসলিম প্রধান দেশগুলোর পশ্চাৎগামিতা ও নিজেদের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে আফ্রিকা ও এশিয়ার তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর উপর ‘উন্নয়নশীল রাষ্ট্র’-নামক একটি দ্বিমুখী ও ঠগবাজি পরিভাষা ব্যবহার করা শুরু করে। এটাকে যদি আমরা অবনতি ও পশ্চাৎগামিতা না-ও বলি তবুও এটা আদতে এক অর্থনৈতিক স্থবিরতা ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ, উভয়ের মাঝে সম্পর্ক যত মজবুত হবে এবং আমদানি যত বৃদ্ধি পাবে, তাদের প্রতি মুসলিম দেশগুলোর আনুগত্য ততই বাড়তে থাকবে। আর এই বশ্যতা প্রতিটি মুসলিম দেশের মাঝে পারস্পরিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও সম্পূরণে ব্যপক প্রভাব ফেলবে। এর ফলে ইসলামী অর্থনীতির স্বতন্ত্র ও স্বাভাবিক অগ্রগতিতে ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে।
‘উন্নয়নশীল দেশেগুলোতে বৈদেশিক সাহায্য’, এই লাইনটা দিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো সবসময় কান ভারী করে রাখে। কথিত এই সাহায্যের ফলে এসকল অনুন্নত (!) দেশগুলোর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি তো দূরে থাকে, বরং দরিদ্রতা আরো বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। ‘বৈদেশিক সহায়তা’র মুখোশ পরে তারা আদতে ছিনতাই করার জন্য ওঁত পেতে বসে থাকে। কারণ, আদতে যে সাহায্য মুসলিম দেশগুলোর দোরগোড়া পর্যন্ত এসে পৌঁছায় তার একটি বিশাল অংশ এজেন্টদের পকেটে চলে যায়। আমেরিকার ইহুদি রাজনৈতিক কৌশল এবং উপনিবেশের নতুন সংস্করণ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে আমেরিকারই কোন এক কোম্পানির প্রধানের মুখ থেকে একটি চমকপ্রদ তথ্য বের হয়ে আসে:
“গত ৫ বছরে আমেরিকার বাইরে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উদ্দশ্যে বিনিয়োগকৃত প্রতিটি ডলারের বিপরীতে আমরা ৪.৬৭ ডলার অর্জন করতে সক্ষম হই। অর্থাৎ, ডলার প্রতি ৩.৬৭ হারে লাভ হয়, যা মূলধনের ৩৬৭%।” নিঃসন্দেহে এটা এক প্রকার চুরি; কোন সুস্থ অর্থনীতি এরকম হতে পারে না। [আস-সা‘দানী-মুসতফা-আল-ফিকরুস সাহইউনী ওয়াস সিয়াসাতুল ইয়াহুদী]
বৈদেশিক সহায়তা নিয়ে একটি হাস্যকর উদাহরণ দেওয়া যাক। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল মিশরে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বিষয়ক একটি প্রোগ্রামে সেখানকার ব্যাংকগুলোর সাথে ১৯৭৮-১৯৮১ ইংরেজি বর্ষের অনতবর্তীকালীন সময়কে ঘিরে একটি চুক্তি বাস্তবায়ন করে। তারা ঘোষণা দেয় যে, এই সময়ের মাঝে তারা মিশরকে অর্থনৈতিক দুরাবস্থা থেকে বের করে আনবে এবং Balance of trade বা বাণিজ্যিক ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে অক্ষমতার হার কমিয়ে আনবে [বাণিজ্য ভারসাম্য (ইংরেজি: Balance of Trade) হচ্ছে কোন দেশের অর্থনীতির একটি নির্দিষ্ট সময়ের মোট রপ্তানি ও মোট আমদানির আর্থিক মূল্যের পার্থক্য]। মিশরের এডুকেশনাল ইনস্টিটিউটের প্রথম বিশেষজ্ঞ ডক্টর রমযী যাকী এর গবেষণা থেকে বেরিয়ে আসে যে,
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল যখন মিশরে প্রবেশ করে (১৯৭৮ সাল) তখন মিশরের ঋণ ছিল ৮০০০ মিলিয়ন ডলার। চার বছর পর (১৯৮১ সাল) যখন তারা মিশর থেকে চলে যায় তখন এই ঋণ ১৮,০০০ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়! সহজভাবে বললে, প্রতিটি মিশরীয় নাগরিক তখন বিশ্বের কাছে ৪২২ ডলার ঋণী। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হলো, তখন কারো বাৎসরিক আয় ৪৬০ ডলারের বেশি ছিল না!
৭. মুসলিম দেশগুলোর পারস্পরিক ভৌগলিক অবস্থান ও সহজ সম্পর্কের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও উপনিবেশিক শাসন এই সম্পর্কের মাঝে বাধ সাধে। তারা মুসলিমদের মাঝে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করতে চায়। কিন্তু তারা আবার কিছু কিছু মুসলিম দেশের মাঝে সম্পর্ক তৈরি হওয়াকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। হ্যাঁ, এর মাঝেও স্বার্থ রয়েছে ঠিকই। যেমন বন্দর, উৎপাদনকেন্দ্র ইত্যাদি রপ্তানি বিষয়ক স্বার্থে তারা কিছু মুসলিম দেশগুলোর মাঝে সম্পর্ক ও যোগাযোগ বর্তমান থাকায় কোন আপত্তি করে না। যেমনটি ঘটেছে তিউনিসিয়া, মরক্কো, আলজেরিয়া, মৌরিতানিয়া, নাইজেরিয়া ইত্যাদি দেশগুলোর ক্ষেত্রে।
ইসলামি অর্থনীতির অনুপস্থিতি মুসলিম বিশ্বের এই অর্থনৈতিক দুরাবস্থা এবং উপনিবেশিক শক্তির টিকে থাকার মূল কারণ। মুসলিম বিশ্ব যে অবনতি স্বচক্ষে দেখল তার বোঝা ইসলাম বহন করবে না; বরং এটা মুসলমানদের উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে ন্যায্য শাস্তি।
আল্লাহ ﷻ বলেন:
{আর যে আমার যিকর থেকে বিমুখ হবে তার জন্য থাকবে এক সংকীর্ণ জীবন। কিয়ামতের দিন আমি তাকে অন্ধ অবস্থায় উঠাবো। সে তখন বলবে, ‘হে আমার রব! আমাকে কেন অন্ধ অবস্থায় উঠালে? আমি তো চক্ষুমান ছিলাম!’ আল্লাহ ﷻ তখন বলবেন, ‘আমার আয়াত তোমার কাছে আসলে তুমি এভাবেই ভুলে গিয়েছিলে। আর আজ তোমাকে ভুলে যাওয়া হবে।} [ত্বহা: ১২৪-১২৬]
আল্লাহ ﷻ আরো বলেন:
{আরো (আমার কাছে ওয়াহী করা হয়েছে এই) যে, তারা যদি সত্য-সঠিক পথে প্রতিষ্ঠিত থাকত, তাহলে আমি তাদেরকে প্রচুর পানি পান করাতাম।} [সূরা জিন: ১৬]
এভাবেই তো মুসলমানরা তাদের মর্যাদা হারিয়ে ফেলে। নিজ শক্তিমত্তা বিলীন হয়ে যায়। ভিত্তি ধ্বসে পড়ে। মুসলিম বিশ্বের অবনমনে ভিনদেশীরা এসে তাদের ক্ষেতে লাঙ্গলের ফলা মারতে থাকে। উম্মতকে দুর্বলতা গ্রাস করে বসে। এ যেন নাবী ﷺ এর সেই সতর্কবার্তার সত্যায়ন, যখন তিনি বলেছিলেন,
হে মুহাজিরগণ! তোমরা পাঁচটি বিষয়ে পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। তবে আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি যেন তোমরা তার সম্মুখীন না হও। যখন কোন জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে তখন সেখানে মহামারী আকারে প্লেগরোগের প্রাদুর্ভাব হয়। তাছাড়া এমন সব ব্যাধির উদ্ভব হয়, যা পূর্বেকার লোকেদের মধ্যে কখনো দেখা যায়নি। যখন কোন জাতি ওযন ও পরিমাপে কারচুপি করে তখন তাদের উপর নেমে আসে দুর্ভিক্ষ, কঠিন বিপদ-মুসীবত এবং যখন যাকাত আদায় করে না তখন আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ বন্ধ করে দেয়া হয়। যদি ভূ-পৃষ্ঠে চতুস্পদ জন্তু ও নির্বাক প্রাণী না থাকতো তাহলে আর কখনো বৃষ্টিপাত হতো না। যখন কোন জাতি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, তখন আল্লাহ তাদের উপর তাদের বিজাতীয় দুশমনকে ক্ষমতাশীন করেন এবং সে তাদের সহায়-সম্পদ সবকিছু কেড়ে নেয়। যখন তোমাদের শাসকবর্গ আল্লাহর কিতাব মোতাবেক মীমাংসা করে না এবং আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানকে গ্রহণ করে না, তখন আল্লাহ তাদের পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেন। [হাসান হাদীস, ইবনু মাজাহ ২/৪০১৯]
এই হাদীস সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে মুসলিম বিশ্বের বর্তমান দুর্দশার সারকথা ব্যক্ত করছে। মুসলিম সমাজে ছড়িয়ে পড়া পাশ্চাত্য থেকে আমদানিকৃত সামাজিক ব্যধি, উপর্যুপরি খরা এবং গণ হারে মরুকরণ, শাসকদের ভয় এবং শাসক ও শাসিতদের মাঝে পারস্পরিক আস্থাহীনতা, প্রচণ্ড রকমের বহিঃস্থ চ্যালেঞ্জ (ক্রুসেড, কমিউনিজম, জায়োনিস্ট, হিন্দু এবং মুসলিম দেশগুলোর আনাচে-কানাচে বিভিন্ন মতাদর্শ) এবং নিজেদের মাঝে সৃষ্ট যুদ্ধ-বিগ্রহ; এগুলোই হাদীসে বর্ণিত মুসলিমদের বর্তমান দুরাবস্থার সারাংশ বিশেষ।