উস্তায আব্দুল হাকীম মাদানী
আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন। ওয়াস স্বলাতু ওয়াস সালামু আলা রাসূলিহীল কারীম। আম্মা বা’দ।
মহান আল্লাহর প্রশংসা ও তাঁর নবীর প্রতি দরূদ পাঠের পর আল্লাহ তা’আলার কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা যে, তিনি আমাদেরকে উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো যোগ্যতা ছাড়াই আলেমদের মাঝে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তবে আমাদের সকলকে একটি বিষয়ে সতর্ক থাকা আবশ্যক যে, আমাদের কারো মাঝেই যেন এ ধারণার বীজ বপণ না হয় যে, আমি একজন আলেম। কেননা আলেম হওয়া সাধারণ কোন বিষয় না। প্রকৃত আলেমগণ আল কুরআন, তাফসীর, হাদীস, ফিক্বহ, উসূল, ভাষাসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহে পারদর্শী হয়ে থাকেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে পরবর্তী খোলাফায়ে রাশেদীন রাযিয়াল্লাহু আনহুম, ওমর ইবনু আব্দিল আযীয, ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম,আবূ হানীফা, আহমাদ বিন হাম্বল, ইমাম শাফেঈ, ইমাম মালিক, ইমাম তিরমিযী, আবূ দাঊদ, ইবনু তাইমিয়্যাহ, ইবনুল কাইয়্যিম, ইবনু কাছীর, ইবনু হাজার, নাসিরুদ্দীন আলবানী রাহিমাহুমুল্লাহ প্রমুখ এরা হলেন প্রকৃত আলেম। আর আমরা কেবলমাত্র তাদের পথ অনুসরণ ও তাদের পদধূলী নিয়ে বিচরণ করার চেষ্টা করি মাত্র।
কেননা সালাফদের ইখলাস, তাক্বওয়া, সরলতা, দুনিয়াবিমুখতা, পরকালীন ভীতি, সাধারণ মানুষের জন্য চিন্তা-ভাবনা ও কল্যাণকামনা, ইলম অর্জন ও গবেষণা এবং সে ক্ষেত্রে সময়, শ্রম ও সাধনা ব্যয়, দ্বীন সংরক্ষণে আত্মত্যাগ, আত্মিক ও বাহ্যিক আচার-আচরণ এককথায় সারা জীবন ও কর্ম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাতে ভরপুর।
আমরা যদি সালাফদের আদর্শপূর্ণ জীবনকে সামনে রেখে আমাদের ত্রুটিপূর্ণ জীবনের দিকে লক্ষ্য করি তাহলে আমরা নিজেদেরকে আলেম বলতে লজ্জাবোধ করব ও অনুতপ্ত হওয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট।
কিন্তু আফসোস ওখানেই আমরা সালাফদের জীবন ও কর্ম না জেনে নিজেদেরকে আলেম বলে প্রচার করতে মোটেই দ্বিধাবোধ করছি না।
আমাদের উচিত নিজেদের মর্যাদা সম্পর্কে অবহিত হওয়া এবং উম্মতের এই মহান দায়িত্বকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা। যদি এই ছোট্ট উপলব্ধিটুকু নিজেদের মাঝে প্রতিস্থাপন করতে পারি তাহলে আমাদের পথচলা অনেকটা সহজ হবে। আলোচ্য প্রবন্ধে সংশ্লিষ্ট শিরোনাম সম্পর্কে যৎসামান্য আলোচনার প্রচেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
ত্বলিবুল ইলমদের জন্য প্রথম কর্তব্য হলো নিয়তকে একনিষ্ঠ করা। সালাফগণ নিজেদের অন্তরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতঃ তাঁদের নিয়ত পর্যালোচনা করতেন। ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
فمن خلصت نيته في الحق ولو على نفسه كفاه الله ما بينه وبين الناس ومن تزين بما ليس فيه شانه الله
যে ব্যক্তি সত্যের পথে তাঁর নিয়তকে খাঁটি করবে, যদিও তা নিজের বিরুদ্ধে হয় তাহলে আল্লাহ তার এবং মানুষের মধ্যস্থিত সম্পর্কের জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবেন। পক্ষান্তরে যে নিজেকে ঐ জিনিস দ্বারা সুসজ্জিত করবে না যা তার ভেতরে নেই আল্লাহ তাকে লাঞ্ছিত করবেন (খালেদ আস সাবত, আমালুল ক্বুলূব, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৬৪)। সুফিয়ান ইবনু ছাওরী রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
ما عالجت شيئاً أشد علي من نيتي
আমি নিয়তের চেয়ে অন্য কিছু দেখি না যা পরিশুদ্ধ করা এত কঠিন (মুনত্বলাক্বাতু ত্বলিবুল ইলম, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৪১)। আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু ‘আনহু বলতেন,
ليس العلم بكثرة الرواية إنما العلم خشية الله
বেশি বর্ণনা করা ও অধিক পরিমাণ আক্ষরিক জ্ঞান হাসিল করার নাম ইলম নয়, বরং ইলম হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার ভয়ের নাম (দুররুল মানছুর খন্ড-৭, পৃষ্ঠা-২১)।
একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই ইলম অর্জন করতে হবে। সুনাম সুখ্যাতি জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ইলম অর্জনের ফলাফল খুবই ভয়াবহ।
মহান আল্লাহ বলেন,
وما أمروا إلا ليعبدوا الله مخلصين له الدين
আর তাদেরকে কেবল এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল তারা যেন আল্লাহর ইবাদত করে এবং তারই জন্য দ্বীনকে একনিষ্ঠ করে (বায়্যিনাহ/৫)। ইউসুফ ইবনু হুসাইন রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
شيء في الدنيا الإخلاص وكم أجتهدُ في إسقاط الرياء عن قلبي فكأنه ينبت على لون آخر
দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান বিষয় হলো ইখলাস। আমার অন্তর থেকে রিয়া বা লোক দেখানোর মানসিকতা তাড়াতে কতই না চেষ্টা করেছি। কিন্তু মনে সে নতুন রঙে গজিয়ে ওঠেছে (মাদারিজুস সালেকীন, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-৯৬)।
ইলম অর্জনের ক্ষেত্রে কোমলতা অবলম্বন করতে হবে। কেননা যা কিছুতে কোমলতা থাকে, কোমলতা সেটাকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে। তাই ইলমে দ্বীন অর্জনে কোমলতা অবলম্বন খুবই জরুরী একটি বিষয়। ইলমের সকল বিভাগ একসাথে শেখার অপচেষ্টা করা যাবে না। ইবনু শিহাব যুহরী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, যে ত্বলিবুল ইলম একত্রে সকল ইলম অর্জনের ইচ্ছা করে তার সকল ইলম একসাথে বিলুপ্ত হয়ে যায়। বরং ইলম অর্জন করতে হবে রাতদিন ব্যয় করে ধীরে ধীরে। এর বাস্তবতায় জনৈক কবি বলেন,
اليوم علم وغدا مثلُه من نُخب العلم التي تُلتقط
يُحصِّل المرء بها حكمة وإنما السيل اجتماع النقط
আজ কিছু ইলম, কালকে আরো কিছু, এভাবেই কুড়াতে হয় পছন্দনীয় ইলমগুলো।
ক্রমধারায় অর্জিত হলে তা হয় প্রজ্ঞাময়; জেনে রাখ, ফোঁটা ফোঁটা জল জমাট হয়েই তৈরি হয় বন্যা।
নিজের সময়, শ্রম, সাধনা সবকিছুই ইলম অর্জনের জন্য বিলিয়ে দিতে হবে। কোনোক্রমেই হতোদ্দম হওয়া যাবে না। ইলম অর্জনের জন্য ইস্পাত ন্যায় কঠিন মানসিকতা ও ধৈর্যশীল হতে হবে। কোনোক্রমেই হাল ছেড়ে দেয়া যাবে না। ইলম অর্জনের ক্ষেত্রে সালাফগণ যে সকল শিক্ষাক্রম-নীতি অনুসরণ করেছেন আমাদের সেসব অনুসরণ করতে হবে। ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
الناس أحوج إلى العلم منهم إلى الطعام والشراب لأن الطعام والشراب يحتاج إليه في اليوم مرة أو مرتين والعلم يحتاج إليه في كل وقت
মানুষ খানাপিনার চেয়ে ইলমের প্রতি বেশি মুখাপেক্ষী। কেননা দিনে মাত্র দুই-তিনবার খানাপিনার প্রয়োজন হয়। কিন্তু ইলমের প্রয়োজন প্রতি মুহূর্ত এবং সারা জীবন (মাদারিজুস সালেকীন পৃষ্ঠা-৪৪)। সাথে সাথে সময়ের মূল্যায়ন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সম্পদের চেয়ে ইলম অনেক উত্তম ও মূল্যবান। আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
العلم خير من المال العلم يحرسك وأنت تحرس المال العلم يُكسِبُ العالم الطاعة في حياته وجميل الأحدوثة بعد موته وصنيعة المال تزول بزواله مات خزّان المال وهم أحياء
ইলম সম্পদের চেয়ে উত্তম। কেননা ইলম তোমাকে পাহারা দেয় আর তুমি পাহারা দাও সম্পদকে। আলেম ব্যক্তির জীবনে ইলম নিয়ে আসে মানুষের আনুগত্য, আর মৃত্যুর পর তাকে সবাই উত্তমভাবে স্মরণ করে। আর মালের মালিক মারা গেলে মালও তার হাতছাড়া হয়ে যায়। বরং মালের মালিকরা জীবিত হলেও মৃত থেকে যায়। (বাহহারুল আনওয়ার, পৃষ্ঠা-৭৬)
প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে যে, প্রতিষ্ঠান থেকে যেন শুধু বছর শেষে সার্টিফিকেট বেরিয়ে না যায় বরং প্রকৃত আলেম বের হয়। বর্তমানে এই বিষয়টি আমাদের প্রকৃত ইলম অর্জনের পথে বিশাল প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইলম অর্জনের চেয়ে সার্টিফিকেট অর্জনই একজন ত্বলিবুল ইলমের মৌলিক উদ্দেশ্য হয়ে গেছে। যা অদূর ভবিষ্যতে আমাদের ত্বলিবুল ইলমদের জন্য ধ্বংস ব্যতীত আর কিছুই ডেকে আনবে না।
ত্বলিবুল ইলমদের জন্য আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। তা হলো আনানিয়্যাহ। অর্থাৎ, আমিত্ব। সালাফগণ ইলম অর্জন করতেন।পরস্পরের মাঝে সেই ইলম বিতরণ করতেন। অর্জিত ইলমে কোন ত্রুটি পরিলক্ষিত হলে সংশোধন করে নিতেন। পরস্পরের ভুল শোধরাতে তারা ইলমী পন্থা অবলম্বন করতেন। কখনোই তাদের মাঝে আমিত্বভাব কাজ করত না। কিন্তু বর্তমানে ত্বলিবুল ইলমরা একটু পড়াশুনা জানলেই আমিত্বভাব নিয়ে চলে আসে। পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ ও হিংসার মনোভাব পোষণ করে। আলেমদের প্রতি সহনশীলতা মনোভাব রাখতে পারে না। মহান আল্লাহ এরকম ত্বলিবুল ইলমদের সহায় হৌন এবং উত্তম পরস্পরের প্রতি উত্তম আচরণ করার তৌফীক দান করুন। ইকরিমা রাহিমাহুল্লাহ বলতেন,
إن لهذا العلم ثمنا قيل وما هو قال أن تضعه فيمن يحسن حمله ولا يضيعه
এই ইলমের একটি মূল্য আছে। জিজ্ঞেস করা হলো, কী সেই মূল্য? তিনি বললেন, এর মূল্য হচ্ছে সে ব্যক্তিকে ইলম দেওয়া যে এর সঙ্গে সদাচার করে এবং একে ধ্বংস করে না।
আমাদের সবাইকে ইলম অর্জনের প্রতি উদ্বুদ্ধ হতে হবে। কেননা মূর্খতার শেষ পরিণতি ধ্বংস বৈ আর কিছু না। ইবনুল কায়্যিম রাহিমাহুল্লাহ বলেন বলেন,
الجهل داء قاتل وشفاؤه أمران علم من القرآن أو من سنة يجعله ليس من الأحياء، فالعالمون أحياء وغيرُهم أموات
মূর্খতা হচ্ছে জীবননাশক ব্যাধি। এটা কখন রোগীকে মেরে ফেলে রোগী তা নিজেও টের পায় না। আর এর আরোগ্য রয়েছে দুটি বস্তুতে। আল কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান। অথবা বলা যায়, মূর্খতা মানুষকে মৃতের কাতারে নিয়ে যায়। অতএব কেবল ইলমওয়ালারা জীবিত, অন্যরা মৃত।
পরিশেষে স্বরণ করছি শ্রদ্ধেয় বড় ভাই শাহাদাৎ হুসাইন খান ফায়সাল রাহিমাহুল্লাহ এর কথা। গত বছর এ মাসেই তিনি মহান রবের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছেন। আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফিরদৌস দান করুন। অল্প সময়ের ব্যবধানে তিনি তরুণদের মাঝে ইলম অর্জনের আগ্রহবোধ ও সেজন্য কিভাবে ত্যাগ করতে হয় তার এক অনন্য নজীর আমাদেরকে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে প্রকৃত ত্বলিবুল ইলম হওয়ার তৌফীক দান করুন। আমীন!