মূল: আব্দুল মুহসিন আল-আব্বাদ আল-বদর
সংক্ষিপ্ত অনুবাদ: সাব্বির রায়হান বিন আহসান হাবিব
[অধ্যয়নরত, কিং আব্দুল আযীয বিশ্ববিদ্যালয় কো-অর্ডিনেটর, আল-ইলম একাডেমী]
নবুওয়তের চরম প্রয়োজনীয়তার সেকাল:
এই উম্মতের মাঝে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নবুওত হলো সবচেয়ে বড়ো নেয়ামত। এই বিশাল নেয়ামতের কারণে উম্মত আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের প্রতি চরম মুখাপেক্ষী। তার আগমনের উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে চলমান ও ভবিষ্যত সময়ের কল্যাণ সম্পর্কে অবহিতকরণ এবং সর্বযুগের অকল্যাণ সম্পর্কে সতর্কীকরণ। তার আগমন এমন সময়ে ঘটেছিল যখন কোনো রসূল বর্তমান ছিলেন না। সেসময় যাবতীয় আসমানী কিতাব ছিল নিশ্চিহ্ন প্রায়। ভ্রষ্টতা ও অজ্ঞতায় ছেয়ে গিয়েছিল গোটা বিশ্ব। বিশ্বাস, সংস্কৃতি, চারিত্রিক দিক থেকে মানুষের অবস্থা হয়েছিল শোচনীয়। এহেন দুরবস্থা থেকে তিনি ﷺ মানবজাতিকে ইলম ও হিদায়াতের সুবিশাল অট্টালিকার দিশা দেন। মানব-অন্তরগুলোকে এমন দিকনির্দেশনা দেন যাতে সেখানে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও স্থান না থাকে।
রাসূল ﷺ এর নবুওত নিয়ে মুশরিকদের আপত্তি:
সীরাতে মুস্তাকীমের পথ দেখানোর জন্য যখন রাসূল সাঃ নবুওতপ্রাপ্ত হন, তখন মুশরিকরা তাদের সাধ্যমতো রাসূল সাঃ এর সাথে শত্রুতামূলক আচরণ এবং মানুষকে তাঁর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে শুরু করে। যাদুকর, গণক, পাগল ইত্যাদি নিকৃষ্ট বিশেষণের মাধ্যমে তারা রাসূল সাঃ কে অপমান করতে শুরু করে। অথচ রাসূল ﷺ এর সোনালী অতীত সম্পর্কে অন্যদের চেয়েও মক্কার মুশরিকরা বেশি অবগত ছিল। কিন্তু এরপরও এতকিছুর মূল কারণ হলো হিংসা ও অহংকার। আল্লাহ তাআলা বলেছেন:
وَ اَقۡسَمُوۡا بِاللّٰهِ جَهۡدَ اَیۡمَانِهِمۡ لَئِنۡ جَآءَهُمۡ نَذِیۡرٌ لَّیَکُوۡنُنَّ اَهۡدٰی مِنۡ اِحۡدَی الۡاُمَمِ ۚ فَلَمَّا جَآءَهُمۡ نَذِیۡرٌ مَّا زَادَهُمۡ اِلَّا نُفُوۡرَۨا
তারা দৃঢ়তার সাথে আল্লাহর শপথ করে বলত যে, তাদের নিকট কোন সতর্ককারী এলে তারা অন্য সব সম্প্রদায় অপেক্ষা সৎ পথের অধিকতর অনুসারী হবে। কিন্তু তাদের নিকট যখন সতর্ককারী এলো তখন তারা শুধু তাদের বিমুখতাই বৃদ্ধি করল। ফাতির: ৪২।
কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাদের এই অপত্তিগুলো খণ্ডন করতঃ সমগ্র বিশ্বকে জানিয়ে দিলেন যে, বিষয়াবলীর সিদ্ধান্ত একমাত্র তাঁরই হাতে। সৃষ্টি তাঁর। এই সৃষ্টির মাঝে তিনি যদি কাউকে সম্মানিত করেন তবে সেটা তাঁরই ইচ্ছাধীন। তিনি তাঁর রিসালাতকে কোথায় পাঠাবেন সে সম্পর্কে তিনিই সম্যক অবগত। (আনআম: ১২৪)
শাইখাইনের শর্ত অনুপাতে, ইমাম হাকিম বর্ণিত হাদীসে এসেছে যে, আবূ জাহল একদিন রাসূল সাঃ কে বলেছিল যে, আমরা তোমাকে মিথ্যারোপ করি না; বরং তুমি যদ্বারা প্রেরিত হয়েছ তার মিথ্যারোপ করি।’ অতঃপর আল্লাহ তাআলা এই আয়াত ইরশাদ করলেন:
فَإِنَّهُمْ لا يُكَذِّبُونَكَ وَلَكِنَّ الظّالِمِينَ بِآَياتِ اللَّهِ يَجْحَدُونَ
কিন্তু তারা তো তোমাকে অস্বীকার করে না, বরং যালিমরা আল্লাহর আয়াতসমূহকে অস্বীকার করে। আনআম: ৩৩। (আল-ইলালুল কাবীর: ৩৫৪, মুরসাল সহীহ)
রাসূল ﷺ এর চরিত্র:
রাসূল ﷺ চারিত্রিক উৎকর্ষতা সম্পর্কে তাঁর কাছের ও দূরের কিছু মানুষের সাক্ষ্য:
১. খাদিজা (রাঃ) এর সাক্ষ্য: রাসূল ﷺ হেরা গুহায় প্রথমবারের মতো নবুওতপ্রাপ্ত হওয়ার পর যখন ঘরে ফিরে খাদিজা (রাঃ)-কে বললেন: “আমি আমার নিজেকে নিয়ে ভয়ে আছি”। তখন খাদিজা (রাঃ) বললেন: “আল্লাহ্র কসম, কক্ষনো না। আল্লাহ্ আপনাকে কক্ষনো অপমানিত করবেন না। আপনিতো আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার করেন, অসহায় দুর্বলের দায়িত্ব বহন করেন, নিঃস্বকে সাহায্য করেন, মেহমানের মেহমানদারী করেন এবং দুর্দশাগ্রস্তকে সাহায্য করেন।” বুখারী: ০৪।
২. কা’বা পুনঃনির্মানের সময় কুরাইশ কাফেরদের সাক্ষ্য: নাবী ﷺ এর নবুওতের পূর্বে যখন কুরাইশরা কাবা পুনঃনির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় তখন হাজরে আসওয়াদ স্থাপন নিয়ে কুরাইশদের মাঝে মতানৈক্য দেখা দেয়। দীর্ঘ বাদানুবাদের পর তারা এমর্মে একমত হয় যে, যিনি দরজা দিয়ে সর্বপ্রথম প্রবেশ করবেন আমরা তার সিদ্ধান্ত মেনে নেব। অতঃপর দেখা গেল যে সর্বপ্রথম প্রবেশকারী হলেন মুহাম্মাদ ﷺ। এতে কুরাইশরা সকলেই খুশি হয়ে গেল এবং বলে উঠল, “আল-আমীন এসেছে, মুহাম্মাদ এসেছে”।
৩. রাসূল ﷺ এর সততার ব্যাপারে কুরাইশদের স্বীকৃতি প্রদান: নবুওতের প্রাথমিক সময়ে একদিন রাসূল ﷺ সাফা পাহাড়ে আরোহণ করে সকলকে সমবেত হওয়ার জন্য আহ্বান করলেন। তিনি ﷺ সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “বল তো, আমি যদি তোমাদের বলি যে, শত্রুসৈন্য উপত্যকায় এসে পড়েছে, তারা তোমাদের উপর অতর্কিতে আক্রমণ করতে উদ্যত, তোমরা কি আমাকে বিশ্বাস করবে? তারা বলল, হাঁ আমরা আপনাকে সর্বদা সত্য পেয়েছি।”… [বুখারী: ৪৭৭০]
৪. আবু জাহলের স্বীকারোক্তি: আবু জাহল একদিন বলেছিল, “আমরা তোমাকে মিথ্যারোপ করি না; বরং তুমি যদ্বারা প্রেরিত হয়েছ তার মিথ্যারোপ করি।”
৫. হিরাক্লিয়াসের দরবারে আবু সুফিয়ানের সাক্ষ্য।
৬. রাসূল ﷺ এর লেনদেন ও সৎ-সাহচর্চ সম্পর্কে সায়েব আল-মাখযূমীর সাক্ষ্য: স্বয়ং সায়েব (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ একদা আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট উপস্থিত হয়ে শুনতে পাই যে, লোকেরা আমার সম্পর্কে আলোচনা করছে এবং আমার প্রশংসা করছে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আমি তার সম্পর্কে তোমাদের চাইতে অধিক অবগত। তখন আমি বলিঃ আমার বাপ-মা আপনার জন্য উৎসর্গ হোক! আপনি ঠিকই বলেছেন। আপনি আমার উত্তম সাথী ছিলেন। আপনি আমার সাথে কোন দিন মারামারি এবং ঝগড়া-ফ্যাসাদ করেননি। [আবূ দাউদ: ৪৭৮১, সহীহ]
৭. নাবী ﷺ এর সত্যবাদিতা সম্পর্কে আব্দুল্লাহ বিন সালামের (রাঃ) স্বীকারোক্তি।
৮. মিকরায বিন হাফস বিন আহনাফের সাক্ষ্য।
রাসূল সাঃ এর প্রতি উম্মতের কিছু হক হলো:
তারা এমর্মে সাক্ষ্য দিবে যে,
১. রাসূল সাঃ হলেন সমগ্র জিন ও মানবজাতির জন্য আল্লাহর প্রেরিত রাসূল।
২. তাঁর শরীয়তের কার্যকারিতা কিয়ামত পর্যন্ত বহাল থাকবে।
৩. তাঁর শরীয়ত সার্বজনীন। কেউ এর গণ্ডি থেকে মুক্তি নয়। রাসূল সাঃ বলেন,
وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لاَ يَسْمَعُ بِي أَحَدٌ مِنْ هَذِهِ الأُمَّةِ يَهُودِيٌّ وَلاَ نَصْرَانِيٌّ ثُمَّ يَمُوتُ وَلَمْ يُؤْمِنْ بِالَّذِي أُرْسِلْتُ بِهِ إِلاَّ كَانَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ
সে সত্তার কসম, যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ, ইহুদি হোক আর খৃষ্টান হোক, যে ব্যাক্তই আমার এ আহবান শুনেছে, অথচ আমার রিসালাতের উপর ঈমান না এনে মৃত্যুবরণ করেছে, অবশ্যই সে জাহান্নামী হবে। (মুসলিম: ১৫৩)
৪. তাঁর শরীয়ত স্থান-কালভেদে উপযুক্ত বা যৌক্তিক। তাঁর দেখানো পথে না চললে দুনিয়ায় কোনো সফলতা নেই আর আখিরাতে নেই কোনো নাজাত।
৫. তিনি ﷺ হলেন উম্মতের একমাত্র আদর্শ।
৬. অদৃশ্য, অতীত এবং ভবিষ্যত সম্পর্কে সংবাদ দানে তিনি সত্যবাদী এবং সত্যপ্রাপ্ত।
৭. তার ভালোবাসা দিয়ে এই অন্তর আবাদ করতে হবে; যেই ভালোবাসা স্বয়ং নিজেকে, এমনকি বাবা-মা, সন্তান-সন্ততি ও সমগ্র মানবকুলকে ভালোবাসার চেয়েও বৃহৎ। তার প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শনের অন্যতম মাধ্যম হলো তাঁর শরীয়তকে ভালোবাসা এবং সম্মানের সহিত নিজ জীবনে এর বাস্তবায়ন ঘটানো।
৮. ইবাদত হবে একমাত্র আল্লাহর জন্য এবং একমাত্র সেই পদ্ধতিতে যেই পদ্ধতি আল্লাহর রাসূল ﷺ অংকন করে দিয়ে গিয়েছেন। সুতরাং, তার শরীয়ত ব্যতীত ইবাদত গ্রহণযোগ্য নয়। রাসূল ﷺ বলেন,
مَنْ أَحْدَثَ فِيْ أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيْهِ فَهُوَ رَدٌّ
কেউ আমাদের এ শরী‘আতে নেই এমন কিছুর অনুপ্রবেশ ঘটালে তা প্রত্যাখ্যাত। (বুখারী: ২৬৯৭)
শাইখুল ইসলাম মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব এই বিষয়গুলোকে খুব সংক্ষিপ্তভাবে এক কথায় প্রকাশ করেছেন। মুহাম্মাদ সা: কে রাসূল হিসেবে সাক্ষ্য দেওয়ার উদ্দেশ্য সম্পর্কে শায়খ বলেন:
طاعته فيما أمر وتصديقه فيما أخبر واجتناب ما نهى عنه وزجر وأن لا يعبد الله إلا بما شرع
অর্থাৎ, তার আদেশকৃত বিষয়ের আনুগত্য করা, তার দেওয়া সংবাদকে সত্য বলে মেনে নেওয়া, তিনি নিষেধ করেছেন ও সতর্ক করেছেন এমন বিষয় থেকে দূরে থাকা এবং একমাত্র তার শরীয়ত অনুযায়ী ইবাদত-কর্ম করা।
৯. তাঁর প্রশংসায় জিহ্বা সিক্ত রাখা; তবে সেক্ষেত্রে সদা সতর্ক থাকতে হবে, যাতে এমন কিছু না ঘটে যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অসন্তোষের কারণ হতে পারে।
১০. তাঁর সুন্নতের সৌন্দর্যতা ও প্রয়োজনীয়তাকে মানুষের সামনে তুলে ধরা।
১১. তাঁর উপর দুরুদ পাঠ করা। কৃপণ তো সেই ব্যক্তি যার সামনে রাসূলের নাম উচ্চারিত হওয়ার পরও সে তাঁর উপর দুরুদ পাঠ করে না।
পক্ষান্তরে, উম্মতের প্রতি রাসূল সাঃ এর হক হলো –
রবের রিসালাতকে তাদের মাঝে যথাযথভাবে পৌঁছে দেওয়া। যার মাঝেই মূলত উম্মতের দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ নিহিত। বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূল ﷺ বলেন,
وَقَدْ تَرَكْتُ فِيكُمْ مَا لَنْ تَضِلُّوا بَعْدَهُ إِنِ اعْتَصَمْتُمْ بِهِ كِتَابَ اللَّهِ . وَأَنْتُمْ تُسْأَلُونَ عَنِّي فَمَا أَنْتُمْ قَائِلُونَ ” . قَالُوا نَشْهَدُ أَنَّكَ قَدْ بَلَّغْتَ وَأَدَّيْتَ وَنَصَحْتَ . فَقَالَ بِإِصْبَعِهِ السَّبَّابَةِ يَرْفَعُهَا إِلَى السَّمَاءِ وَيَنْكُتُهَا إِلَى النَّاسِ ” اللَّهُمَّ اشْهَدِ اللَّهُمَّ اشْهَدْ ” . ثَلاَثَ مَرَّاتٍ
আমি তোমাদের মাঝে এমন এক জিনিস রেখে যাচ্ছি, যা দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরে থাকলে তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব।”
আমার সম্পর্কে তোমরা জিজ্ঞাসিত হলে, তখন তোমরা কি বলবে?” তারা বলল, আমরা সাক্ষ্য দিব যে, আপনি (আল্লাহর বানী) পৌছিয়েছেন, আপনার হক আদায় করেছেন এবং সদুপদেশ দিয়েছেন। তারপর তিনি তর্জনী আকাশের দিকে তুলে লোকদের ইশারা করে বললেন, “ইয়া আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাক, তিনি তিনবার এরূপ বললেন। মুসলিম।